কবরের আযাবের কথা কোরআনে উল্লেখ নেই
মৃত্যুর পরের জগৎটা আখেরাত তথা গায়েব জগত। আর এই গায়েব জগত সম্পর্কে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে। (সূরা-বাকারা, আয়াত-১)। প্রভুর সকল গায়েব বিষয়ে ভয় করতে বলা হয়েছে। (সূরা-ইয়াছিন, আয়াত-১১)। আল্লাহ ছাড়া এই গায়েব জগতের জ্ঞান কারো নেই। (সূরা-নামল, আয়াত-৬৫)। (সূরা-ইউনুস, আয়াত-২০)। আল্লাহর কথা একমাত্র কোরআন, আর কোরআন থেকেই গায়েব জগতের বিষয়গুলো আমাদের জানতে হবে। নবী (স.) গায়েব সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না (সূরা আনআম : ৫০) (সূরা-আরাফ, আয়াত-১৮৮)। বিধায় নবী (স.) ওহী ব্যতীত (দ্বীনের কোনো বিষয়ে তথা গায়েব বিষয়ে) কাউকে সতর্ক করেন নি (সূরা-আম্বিয়া, আয়াত-৪৫)। কাজেই গায়েব জগত সম্পর্কে আমাদের একমাত্র কোরআন মোতাবেক ই জানতে হবে ও বিশ্বাস করতে হবে।পবিত্র কোরআনে নেই এমন কথা যদি কেউ হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে গায়েব জগতের সম্বন্ধে বলে থাকেন তাহলে সেটা অবশ্যই পরিহারযোগ্য। যেমন হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে অনেকেই বলেন কবরে ইমান পরীক্ষা করার জন্য নিন্মলিখিত প্রশ্নগুলি করা হবেঃ (১) মান রাব্বুকা- অর্থাৎ তোমার প্রভু কে? (২) মান দ্বীনুকা- অর্থাৎ তোমার দ্বীন কি? (৩) মান হাযা রাজুলুন অর্থাৎ এই ব্যক্তি কে? কিন্তু দুখের বিষয় এই ৩টি প্রশ্ন করে কবরে ইমান পরীক্ষা করা হবে এমন কথা পবিত্র কোরআনে কোনো আয়াতে উল্লেখ নেই। তাছাড়াও উক্ত তিনটি প্রশ্ন দিয়ে কবরে ইমান পরীক্ষা করা হলে ইবলিস এবং ইবলিসের অনুসারীরা ইমান পরীক্ষায় পাশ করে পরিত্রাণযোগ্য বলে গণ হয়ে যায়। কারণ ইবলিসের অনুসারীগণও উক্ত ৩টি প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। কারণ যখন কবরে তাদের প্রশ্ন করা হবে- মান রাব্বুকা, তখন ইবলিসের অনুসারীগণ বলবে আমার প্রভুত আল্লাহ, কারণ ইবলিস ত আল্লাহকে প্রভু বলে স্বীকার করে। (সূরা-হিযর, আয়াত-৩৬)। যখন বলা হবে তোমার দ্বীন কি? তখন তারা বলবে- আমার দ্বীন ইসলাম। কারণ (আসমান যমিনের সকলেই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে)। (সূরা-ইমরান, আয়াত-৮৩)। যখন (নবী (স.) কে দেখিয়ে) প্রশ্ন করা হবে মান হাজা রাযুলুন - এই লোকটি কে? তখন তারা বলবে উনি নবী মোহাম্মদ (স.)। কারণ তৎকালীন সময়ের ইবলিসের অনুসারী কাফেররা নবী (স.) কে দেখেছে ও চিনেছে। তাহলে দেখা গেল উক্ত তিনটি প্রশ্নের উত্তর ইবলিস ও ইবলিসের অনুসারীরা দিতে সক্ষম হয়ে যায় বিধায় তারা পরিত্রাণযোগ্য বলে গণ্য হয়। কিন্তু না, ইবলিস ও ইবলিসের অনুসারীরা পরিত্রাণ পাবে না। বিধায় উপরিউক্ত ৩টি প্রশ্ন দিয়ে মৃত্যুর পর ইমান পরীক্ষা করা হবে না, এটা নিশ্চিত।
তাছাড়াও আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, কবরের আযাব সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে কোনো আয়াতে উল্লেখ নেই। তারপরও যদি কেউ বলে সকল অপরাধীদের জন্যই কবরের আযাব হবে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, ধরুন, প্রথম শিংগায় ফুৎকার দেওয়র পর একজন ব্যক্তির মৃত্যু হলো (সূরা-জুমার, আয়াত-৬৮)। তার পরে ২য় শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নির্জীব কবরস্থ রহিল। ২য় শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার পর সে দন্ডায়মান হইল। (সূরা-জুমার, আয়াত-৬৮)। অর্থাৎ ২য় শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার পর তার দেহে আত্মা সংযোজন করা হলো। (সূরা-তাকভীর, আয়াত-৭)। এইভাবে তাকে কবর থেকে পুনরুজ্জীবিত করা হইল। (সূরা-আবাসা, আয়াত-২২)। তখন তার কবর উন্মোচিত করা হইল। (সূরা-ইনফিতর, আয়াত-৪)। (সূরা-হজ, আয়াত-৭)। (সূরা-আদিয়াত, আয়াত-৯)। এবং তখন কবর থেকে উঠিয়া সকলে প্রভুর দিকে দৌড়াইতে থাকিবে। (সূরা-ইয়াছিন, আয়াত-৫১)। (সূরা-মাআরিজ, আয়াত-৪৩)। যেন তারা পঙ্গপালের মত কবর থেকে বাহির হতেছে। (সূরা-ক্বামার, আয়াত-৭)। তারপর শেষ বিচার শুরু হবে, এই বর্ণনা মোতাবেক রোজ কেয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে যারা মারা গেল তাদের তো কবরে কোনো আযাবের বর্ণনা এখানে আসে নি। কারণ কবর থেকে জীবিত হওয়ার পরওতো বিচারের জন্য চলে গেল। তাদের জন্যতো কবরে জীবিত করে উক্ত ৩টি প্রশ্ন করা হইল না কিংবা তাদের কবরে কোনো শাস্তির বিষয়ে উল্লেখ নেই। তাহলে দেখা গেল ১ম শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে যিনি মারা গেলেন তাকে আর কবরের আযাব ভোগ করা লাগল না। পক্ষান্তরে (প্রচলিত ধর্ম দর্শন মোতাবেক) যখন আদম (আ.) এর একজন সন্তান সে সময় সে মারা গেল এবং কবরস্থ হলো, এবং তাকে কবর থেকে পুনজ্জীবিত করে উক্ত ৩টি প্রশ্নের মাধ্যমে ইমান পরীক্ষা করতঃ সে যথার্থ উত্তর দিতে না পারায় তার কবরের আযাব শুরু হয়ে গেল এবং ১ম শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার দিন পর্যন্ত আযাব ভোগ করল, তাহলে আল্লাহ পাকের নিয়মের বৈষম্যের কারণে একজন দীর্ঘদিন কবরের আযাব দ্বারা আক্রান্ত হইল আর একজন রোজ কিয়ামতের দিন মারা গেল, তিনি কবরের আযাব ছাড়াই সেদিন প্রভুর কাছে দন্ডয়মান হইল। সেক্ষেত্রে আল্লাহর নিয়মের বৈষম্যতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু না আল্লাহ পাকের নিয়মের কোনো পরিবর্তন নেই। (সূরা-বণি ইসরাইল, আয়াত-৭৭)। কারণ সকল বনি আদমের যাত্রা একই সময় থেকে শুরু এই মর্মে আল্লাহ বলেন, 'আমি কি তোমাদের প্রভু নহি'? তখন সকলেই স্বীকার করল, হ্যাঁ, আপনিই আমাদের প্রভু।(সূরা-আরাফ, আয়াত-১৭২)। আর সেই থেকেই জীব জগৎ শুরু। যিনি প্রথম শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার মুহূর্তে মারা গেল, তার যাত্রাও শুরু হয়েছিল ১ম থেকেই। সে জন্ম জন্মান্তরে বিভিন্ন জনমে শাস্তি ভোগ করে সেই দিন পর্যন্ত পৌঁছেছে বিধায় সকলের জন্য একই নিয়ম বা পদ্ধতি। আর সেটাই হচ্ছে জন্মান্তরবাদ পদ্ধতিতে আলমে বরযখে শাস্তি প্রদান। আসলে কবর বলতে মৃত্যুর পর হতে পুনর্জীবিত হওয়া পর্যন্ত এই নির্জীব অবস্থাকে বলে। অর্থাৎ মৃত্যুর পরের অবস্থা কবর। (সূরা-আবাসা, আয়াত-২১)। এর পর আল্লাহ যখন ইচ্ছা তাকে পুনরুজীবিত করেন। (সূরা-আবাসা, আয়াত-২২)। তাহলে বুঝা গেল মৃত্যুর পর কিছুটা সময় নির্জীব অবস্থায় থাকছে। আর এটাকেই কবর বলা হচ্ছে যেহেতু নির্জীব অবস্থায় কোনো কিছু ইমান পরীক্ষা করা বা শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। বিধায় কবরে ইমান পরীক্ষা করা ও আযাবের ঘটনা ভিত্তিহীন। কারণ যেহেতু মৃত্যুর পরে কবর থেকে পুনঃজীবিত করা হচ্ছে, তাহলে পুনঃজীবিত করার পরে সে আর কবরে থাকছে না। কারণ পুনঃজীবিত করে তাকে প্রভুর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে (সূরা-আনাম, আয়াত-৩৬)। সেখানে ইমান পরীক্ষা করার পরে পুনরায় তাকে কবরে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না বিধায় এতে প্রমাণিত হয় যে, কবরে কোনো ইমান পরীক্ষা করা ও আযাব দেওয়া কোনটাই হচ্ছে না। এখানে উল্লেখ্য যে, মৃত্যুর পর পরই তাকে পুনঃজীবিত করে প্রভুর কাছে প্রত্যান্যিত করা হচ্ছে, তখন তার ইমান ও পূর্বকর্ম পরীক্ষা করার পর তার কর্মের প্রতিদান প্রদান করা হবে। (সূরা-হুদ, আয়াত-১১১)। এই লক্ষ্যে তাকে নতুন ভাবে সৃষ্টি করে পুনরায় সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। (সূরা-আরাফ, আয়াত-২৯)। (বিঃ দ্রঃ- এই পুস্তকে জন্মান্তরবাদ অধ্যায়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন) এই ভাবে পুনঃ সৃষ্টির মাধ্যমে তাকে পূর্ব জনম থেকে আড়াল করা হবে, যাতে সে পূর্ব জনমের কোনো স্মৃতি স্মরণ করতে না পারে। এই জন্য আল্লাহ বলেন, 'তাদের সম্মুখে বরযখ থাকিবে পুনঃজীবিত হওয়ার দিন পর্যন্ত' (সূরা-মমিনুন, আয়াত-১০০)। এই আয়াতে বরযখ শব্দ এসেছে, বরযখ শব্দের অর্থ দুই বস্তুর মধ্যস্থিত প্রতিবন্ধকতা। অর্থাৎ পূর্ব জনম ও পরবর্তী জনম এর মধ্যে একটি প্রতিবন্ধকতা। (আরবি অভিধান পৃ. ৬৭১)। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেকের ধারণা বরযখ বলতে কবরকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু না, কবর শব্দ এবং বরযখ শব্দ দুইটিই আরবি শব্দ। আর এই দুইটি শব্দই পবিত্র কুরআনে এসেছে। কবর শব্দ এসেছে সূরা তওবার ৮৪ নং আয়াত থেকে, আর বরযখ শব্দ এসেছে সূরা মমিনুন আয়াত-১০০ থেকে (সুরা রহমান-১৯)। দুইটি শব্দ, দুইটি আয়াত, আর দুইটি আয়াতের দুইটি উদ্দেশ্য, অর্থও দুইটি। কবর শব্দের অর্থ হচ্ছে নীচু ভূমি বা সমাধি (আরবি অভিধান পৃ. ১৯১৯ )। তাহলে দেখা গেল কবর ও বরযখ শব্দের অর্থ এক নয়। সে ক্ষেত্রে যদি কেউ বরযখ শব্দ দিয়ে কবরকে বুঝায় তাহলে বরযখ শব্দের যে আয়াত সেই আয়াতের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। সূরা মমিনুন আয়াত-১০০ এর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। আল্লাহর কোনো আয়াতকে ব্যর্থ করা যাবে না। (সূরা-হজ, আয়াত-৫১)। কাজেই বরযখ শব্দ দিয়ে কবরকে বুঝানো যাবে না। এখানে উল্লেখ্য যে, ইমান পরীক্ষার পরে তার প্রতিদান প্রদান করার লক্ষ্যে আলমে বরযখে পাঠানো হচ্ছে, (সূরা মমিনুন আয়াত-১০০) এখানে উল্লেখ্য যে, যেহেতু এই আয়াতে কবরের কথা উল্লেখ নেই, তাতে প্রমান হয় যে, কবর থেকে পুনঃজিবীত করে প্রভুর কাছে নিয়ে গিয়ে ঈমাণ পরীক্ষার পর তাকে আর কবরে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না, যদি কবরে ফেরত পাঠানো হতো তাহলে উক্ত আয়াতে 'তোমাকে বরযখে রাখা হবে' এ কথাটি না বলে 'তোমাকে কবরে রাখা হবে, পরবর্তী পুনঃজীবিত হওয়ার দিন পর্যন্ত' কিন্তু এমনটি বলা হয় নি বিধায় প্রমাণিত হয় যে, তাকে আর কবরে পাঠানো হয় নি। তাই কবরে কোনো আযাব বা শাস্তি কিছুই হচ্ছেনা, বরং কবর একটি নির্জীব অবস্থা। তা ছাড়া যখনই পুনঃজীবিত করা হচ্ছে, তখন সে আর কবরে থাকছে না। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেকেই বলবে মৃতুর পরে পুনঃজীবিত করে যখন আল্লাহর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন কোনো শরীরে নিয়ে যাওয়া হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ঊাবৎু ড়হবং যধং ঃড়ি নড়ফু, ঙহবং ঢ়যুংরপধষ নড়ফু, ড়ঃযবৎং ধংঃৎধষ নড়ফু. প্রত্যেকের দুইটি দেহ, একটি শারিরীক ও অপরটি হচ্ছে আত্মীক দেহ বা জতিষ্ময় দেহ। মৃত্যুর পর প্রভুর কাছে শারিরীক দেহ তথা ঢ়যুংরপধষ নড়ফু যাচ্ছে না এটা ধ্বংসশীল। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে এটা ধ্বংস হয়ে যায়। কতটা পানিতে কতটাবা মাটিতে, কতেকটা বাষ্পীয়ভাবে ধবংস হয়। মৃত্যুর পরে পুনঃজীতিব করে ধংঃৎধষ নড়ফু বা আত্মিক দেহে তাকে প্রভুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। যেমনটি আমরা নিদ্রা নামে মৃত্যুর সময় কিছুটা বুঝতে পারি। কারণ নিদ্্রাটাও এক প্রকার মৃত্যু। (সূরা-জুমার, আয়াত-৪২)। (সূরা-আনআম, আয়াত-৬০)। নিদ্রার সময় রুহুটা শারিরীক দেহে বিছানায় থেকে যায়, আর নফসটা আত্মিক দেহ ধারণ করে বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করে। ইসলামি ফাউন্ডেশন টিকা নং- ১৫০১। ঠিক মৃত্যুর পরে মানুষের শারিরীক দেহটা ধ্বংস হয়ে যায় আর তাকে পুনঃজীবিত করে তার আত্মিক দেহটা প্রভুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।( সূরা-আনআম, আয়াত-৩৬)। এখন আমরা জানব কিভাবে মানুষের ইমান পরীক্ষা করা হয়। প্রত্যেক জীবের মৃত্যুর পর পুনঃজীবিত করে তাকে প্রভুর কাছে প্রত্যানিত করা হবে। সূরা-আনআম, আয়াত-৩৬)। (সূরা-সেজদা, আয়াত-১১)। সূরা-(আনআম, আয়াত-৬২)। তখন তার সম্মুখ থেকে সকল পর্দা উন্মোচিত হবে এবং তার দৃষ্টি প্রখর করা হবে (সূরা-কাফ, আয়াত-২২)। তখন প্রভুর দিকে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে (সূরা-কিয়াম, আয়াত-২৩)। সেদিন কাফিররাও স্পষ্টভাবে আল্লাহকে দেখতে পাবে। (সূরা-মরিয়ম, আয়াত-৩৮)। তখন বলা হবে মৃত্যুর পুর্বে তোমরা যা কিছু (দেখিতে) কামনা করতে আজ সব দেখলেতো? (সূরা-ইমরান, আয়াত-১৪৩)। তখন তারা বলবে আমরা সব দেখলাম এবং শুনলাম এবং প্রভুকে বিশ্বাসও করলাম। (সূরা-(সেজদা, আয়াত-১২)। তখন বলা হবে তোমাদের আজকের বিশ্বাস কবুল করা হবে না (সূরা-সেজদা, আয়াত-২৯)। তবে যারা পূর্ব থেকে (এহেন দেখে) বিশ্বাসী ছিল তাদেরটা বিশ্বাস কবুল করা হবে। (সূরা-আনআম, আয়াত-১৫৮)। তখন তারা আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি প্রদর্শন করবে। (সূরা-নাহল, আয়াত-১১১)। এবং বলবে হে প্রভু আমরাতো পূর্ব থেকেই বিশ্বাসী ছিলাম। (সূরা-সেজদা, আয়াত-১২)। তখন বলা হবে, তোমরা বিশ্বাসী ছিলে বললেই তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না ইমান পরীক্ষা না করে। (সূরা-আনকাবুত, আয়াত-২)। শুধু মৌখিক ইমান পরীক্ষা করবে না, বরং ইমান অনুসারে পূর্ব কর্ম পরীক্ষা করা হবে। (সূরা-ইউনুস, আয়াত-৩০)। আর এমন একটি কঠিন পরীক্ষা করা হবে, যে পরীক্ষায় কারা প্রকৃতপক্ষে ইবলিসের অনুসারী ছিল, তারা ধরা পড়বে। (সূরা-কালাম, আয়াত-৬)। আর সেই পরীক্ষাটি এমন ্একটি কঠিন পরীক্ষা হবে যে, সেথায় শুধু যালিমরাই আক্রান্ত হবেনা (বরং নামধারী, লেবাসধারী মমিনরাও আক্রান্ত হবে।) (সূরা-আনফাল, আয়াত-২৫)। তখন আকৃতি বিশিষ্ট আল্লাহর পায়ে সেজদা দিতে বলা হবে, তখন তারা সেজদা দিতে সক্ষম হবে না।(সূরা-কালাম, আয়াত-৪২)। কারণ যখন তারা নিরাপদ ছিল, তখন তাদেরকে আহ্বান করা হয়েছিল ঐ সেজদা করতে, (অর্থাৎ আকৃতি বিশিষ্ট আল্লাহর পায়ে) তখন তারা ঐ সেজদা করে নি। (সূরা-কালাম, আয়াত-৪৩)। এইভাবে আল্লাহর পায়ে সেজদার মাধ্যমেই তার পরীক্ষা করেই ইবলিস এবং ইবলিসের অনুসারীদেরকে প্রতিহত করা হবে। কারণ ইবলিসতো আদম কাবায় সেজদা না দিয়েই কাফের। (সূরা-বারাকা, আয়াত-৩৪)। তখন তাদেরকে কর্মফল অনুসারে প্রতিদান দেওয়া হবে। (সূরা-হুদ, আয়াত-১১১)। এই লক্ষে তাদেরকে পুনরায় সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হবে। প্রথম বার যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল। (সূরা-আরাফ আয়াত-২৯)। এভাবে জন্ম জন্মান্তরে চলতে থাকবে। (এই বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন, এই পুস্তকের জন্মান্তরবাদ অধ্যায়ে।) এইভাবে সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তাদের কর্মের প্রতিদান দেওয়া হবে। বিনাদোষে কেউ শাস্তি পেতে পারে না। তবে পুনঃসৃষ্টির এই জীবনটায় পূর্ব জন্ম থেকে অন্তরালে। আর এই জগৎটাকে আলমে বরযোখ বলা হয়। আর তাই আযাবটা কবরে নয় বরং আলমে বরযোখে।
অতএব, সেই দিবস আসার পূর্বেই অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বেই প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আদম কাবায় সেজদা দিয়ে মৃত্যু বরণ করতে হবে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, সেই দিবস আসার পূর্বেই তোমরা প্রভুর আহ্বানে সাড়া দাও। (সূরা-শুরা, আয়াত-৪৭)। কাজেই কোরআন মোতাবেক যারা আখেরাত বিশ্বাস করেনা, বরং হাদিস অনুসারে বিশ্বাসী ছিল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ যারা কোরআন মাফিক আখেরাত বিশ্বাস করে না তারা মমিন ছিলনা। বিধায় তারা ক্ষতির ভিতর নিমজ্জিত। (সূরা-আছর, আয়াত-১)।
ইসলামে জন্মান্তরবাদ
শুক্রবিন্দু হতে আল্লাহ মানব সৃষ্টি করেন পরে তাকে পরিমিত বিকাশ সাধন করেন। (নং-৮০, আয়াত-১৯)। অতঃপর তার পথ সহজ করে দেন (নং-৮০, আয়াত-২০)। অতঃপর তার মৃত্যু ঘটান এবং তাকে কবরস্থ করেন। (নং-৮০, আয়াত-২১)। অতঃপর যখন ইচ্ছা তিনি তাকে সজীব (পুনঃজ্জীবিত) করেন। (নং-৮০, আয়াত-২২)। মৃত্যুর পরে এইভাবে পুনঃজীবিত করে (তাৎক্ষণিকভাবে অর্থাৎ মৃত্যুর পর পরই) প্রভুর কাছে প্রত্যানীত হবে (আনাম, আয়াত-৩৬, ৬২) (সেজদা, আয়াত-১১)। তখন তার পূর্বকর্ম পরীক্ষা করা হবে (সূরা-ইউনুস, আয়াত-৩০)। কর্মে কাহারা শ্রেষ্ঠ তা পরীক্ষা করা হয়। (সূরা-হুদ, আয়াত- ৭)। পূর্ব ইমান পরীক্ষা করা হয়। (সূরা-আনকাবুত, আয়াত-২)। অতঃপর তার কর্মফল অনুসারে প্রতিদান প্রদান করা হবে (সূরা-হুদ, আয়াত-১১১)। এই লক্ষে তাকে পুনরায় তাকে সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হবে, প্রথমবার যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল সেইভাবে। (সূরা-আরাফ, আয়াত-২৯) এই আয়াতে বাদা-য়া শব্দের অর্থ প্রকাশ পাওয়া বা ভ্রমণে বের হওয়া। (আরবী অভিধান পৃ. নং ৬৬৯) বাদা-য়া শব্দের অর্থ মরুভূমিতে অবস্থান করা। (আরবী অভিধান পৃ. নং ৬৬৮) আর কামা অর্থ এইভাবে আর আওয়াদাত শব্দের অর্থ দ্বিতীয় বার আসতে পারা। (আরবী অভিধান পৃ. নং ১৮১৩) গধশরহম ফবাড়ঃরড়হ ংরহপবৎব ংঁপয ধং ঐব পৎবধঃবফ ুড়ঁ রহ ঃযব নবমরহহরহম ংড় ংযধষষ ুড়ঁ ৎবঃঁৎহ" [ঞৎধহংষধঃব ঃড় ঊহমষরংয ঞযব ঐড়ষষু ছঁৎধহ নু আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী (ভারত) এই আয়াতের বাংলা অনুবাদটি মা'আরেফুল কোরআন এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন আল কুরআনুল কারীম, বঙ্গানুবাদ থেকে সমন্বয় করে নেয়া হয়েছে।] অর্থাৎ প্রথমবার সৃষ্টি হয়েছিল মৃত্তিকা হতে, পরে শুক্রবিন্দু হতে, তারপর আলাক হতে, তার পর মাতৃগর্ভ থেকে বাহির করা হয় শিশুরূপে। (সূরা-৪০ আয়াত-৬৭)। (সূরা-হজ, আয়াত-৫)। (সূরা-ফাতির, আয়াত-১১)। অর্থাৎ পুনরায় সৃষ্টিটা হবে মাতৃগর্ভে জন্মলাভ করার মাধ্যমে। এইভাবে তাকে পুনরায় সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হবে। এইভাবে যতবার সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হবে একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থাৎ পুনরায় সৃষ্টি করা হবে প্রথমবার যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। এভাবে চক্রাকারে জীবন-মৃত্যু পুনঃজীবিত ও পুনঃ সৃষ্টির মাধ্যমে বার বার পুনরাবর্তন ঘটানো হবে। এভাবে চক্রাকারে, জীবন-মৃত্যু-কবর-পুনঃজীবিত-প্রভুর কাছে প্রত্যানয়ন-ইমান ও কর্মপরীক্ষা-কর্মফল অনুসারে পারিশ্রমিক প্রদান-পুনঃসৃষ্টির মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা-আবার জীবন-মৃত্যু-কবর-পুনঃজীবিত-প্রভুর কাছে প্রত্যানয়ন-ইমান ও কর্মপরীক্ষা-কর্মফল অনুসারে পারিশ্রমিক প্রদান-পুনঃসৃষ্টির মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা। এখানে উল্লেখ্য যে, এই জীবনচক্র আবর্তনের ফলে দেখা যাচ্ছে (মৃত্যু+মৃত্যু) দুইবার মৃত্যু, আবার (পুনঃজীবিত + পুনঃসৃষ্টি) দুই বার জীবন (প্রভুর কাছে প্রত্যানয়ন + পারিশ্রমিক প্রদান) দুই বার পারিশ্রমিক প্রদান। এমনই ভাবে এই জীবনচক্রে একটা গাণিতিক সূত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, তোমাদেরকে মৃত্যু থেকে জীবন্ত করিয়াছেন। আবার তোমাদেরকে মৃত্যু ঘটাবেন ও পুনরায় জীবন্ত করিবেন অতঃপর প্রভুর দিকে তোমাদিগকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হবে। (সূরা বাকারা : ২৮) এখানে উল্লেখ্য যে, এ আয়াতে মৃত্যু শব্দ দুই বার এসেছে। (আমওয়াতান ও ছুম্মা উমিতুকুম) তোমাদেরকে দুইবার পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে (সূরা-২৮, আয়াত-৫৪)। (সূরা-আহযাব, আয়াত-৩১)। দুইবার মৃত্যু ও দুইবার জীবন দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। (সূরা-৪০, আয়াত-১১)। দুইবার শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং পরে মহাশাস্তির ব্যবস্থা আছে। (তওবা, আয়াত ১০১)। তবে চক্রাকারে জন্ম মৃত্যুর ঘটনায় কমপক্ষে দুইবার পারিশ্রমিক প্রদানের কথাটা উল্লেখ আসছে। তবে সার্বিক ক্ষেত্রে দুইবার কথাটাকে একাধিকবার অর্থে ব্যবহৃত হবে। কারণ, দুইবার কথার মধ্যে একাধিকবার কথাটা এসে যায়। তাই আল্লাহর সৃষ্টি জগতকে এইভাবে একাধিকবার সৃষ্টি ও মৃত্যুর মাধ্যমে একাধিকবার পারিশ্রমিক প্রদানের মাধ্যমে সৃষ্টিতে পুনরাবর্তন ঘটান। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "আল্লাহ ন্যায় বিচারের মাধ্যমে কর্মফল প্রদানের লক্ষ্যে পুনঃসৃষ্টির দ্বারা পুনরাবর্তন ঘটান।" (সূরা-ইউনুস, আয়াত-৪)। বরং তিনি তার পুনরাবৃত্তি ঘটান (সূরা-২৭, আয়াত-৬৪)। তিনি অস্তিত্ব দান করেন ও পুনরাবর্তন ঘটান (সূরা-৮৫, আয়াত-১৩)। এখানে উল্লেখ্য যে, পুনঃজীবিত বা পুনঃ সৃষ্টির বিষয়টি জীবন মৃত্যুর চক্রের প্রক্রিয়ার একটি অংশ। পক্ষান্তরে পুনরাবৃত্তি কথাটি দিয়ে জীবন মৃত্যুর ক্ষেত্রে সব কয়টি স্তরই পর্যায়ক্রমে ঘটানোকে বুঝায়। অর্থাৎ শুক্র বিন্দু থেকে আলাক, তার পর মাতৃগর্ভ থেকে শিশরূপে বাহির করা, পরে দুনিয়াতে জীবনযাপন করা, তারপর মৃত্যু, তারপর কবরস্থ, তারপর পুনঃর্জীবিত, তারপর প্রভুরকাছে প্রত্যানীত হওয়া, তারপর ইমান ও সৎকর্ম পরীক্ষা করা, তারপর কর্মফল অনুসারে পারিশ্রমিক প্রদানের লক্ষ্যে পুনঃ সৃষ্টির মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা। এইভাবে পুরো প্রক্রিয়াটিরই পুনরাবৃত্তি ঘটানো হবে। তাই (সূরা-ইউনুস, আয়াত-৪)। (সূরা-২৭, আয়াত-৬৪)। (সূরা-৮৫, আয়াত-১৩) এই সকল আয়াতে ইয়াদু শব্দ এসেছে, ইয়াদু শব্দের অর্থ পুনরাবৃত্তি বা পুনরাবর্তন ঘটানো। আরবি অভিধান পৃ.১৮১৯। এই সকল আয়াতে জীবন চক্রের প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরেই বার বার ঘটানো কথা বলা হয়েছে, ফলে এই সকল আয়াত দিয়ে পুনঃজীবিত করা হবে কিংবা পুনঃসৃষ্টি করা হবে এটা বুঝানো হয় নি, বরং জীবন মৃত্যু কবর পুরো সৃষ্টি চক্রে অর্থাৎ জীবনচক্রের পুরো প্রক্রিয়াকে বার বার ঘটানো হবে এমনটি বুঝানো হয়েছে। এইভাবে তাদের কৃতকর্মের ফল প্রদান করা হয়। (সূরা-হুদ, আয়াত- ১১১)। কারণ প্রভু কাহারো উপরে জুলুম করেন না (সূরা-১৮, আয়াত-৪৯)। রবং তারা নিজেদের উপর নিজেরাই যুলুম করেছিল, (সূরা-হুদ, আয়াত-১০১)। আল্লাহ কাহারো উপর কোনো জুলুম করে নি, বরং তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। (সূরা-নহল, আয়াত-৩৩)। তাদের কর্মের ফল প্রদানের জন্য "তাদেরকে নতুন ভাবে সৃষ্টি করা হবে।" (সূরা-৩৪, আয়াত-৭)। সেইক্ষণে তাদের "কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করা হবে।" (সূরা-৬৪, আয়াত-৭)। তখন তারা অধোবদন হয়ে প্রভুর কাছে বলবে, "আমরা সব শুনলাম ও দেখলাম আমাদেরকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দাও, যাতে আমরা সৎ কর্ম করতে পারি" (সেজদা, আয়াত-১২)। তখন আল্লাহ বলবেন, "তোমরা তো এই কথাটা মৃত্যুর সময়ও বলেছিলে" (সূরা-২৩, আয়াত-৯৯)। কিন্তু না, ইহা হইবার নয়। ইহা একটা উক্তি মাত্র। (সূরা-২৩, আয়াত-১০০)। বরং তোমাদের পূর্ব জীবন এবং পরবর্তী সৃষ্ট নতুন জীবন এর মাঝখানে থাকবে এক অবেধ্য অন্তরাল, যাতে তোমরা আর কখনও পূর্ব জীবনের কোনো কিছু স্মৃতিতে আনয়ন করতে পারবে না। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "তাদের সম্মুখে থাকবে বারযখ বা অন্তরাল।" (সূরা-২৩, আয়াত-১০০)। এই বরযখের মাধ্যমে তাদেরকে শৃংখলিত রাখা হবে। (সূরা-১৩, আয়াত-৫)। তবে এই শৃংখল বা বরযখ থাকবে আবার মৃত্যুর পরে পুনঃজীবিত হওয়ার দিন পর্যন্ত। (সূরা-২৩, আয়াত-১০০)। কাজেই পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। বরং তোমরা থাকবে অন্তরালে পরবর্তী পুনঃজীবিত না হওয়া পর্যন্ত। এই আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, শেষ বিচারের পূর্বে প্রভুর নিকট উপস্থিতির মাধ্যমে বিচার কার্য করতঃ ইমান ও সৎ কর্মের পরীক্ষা করতঃ পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে। এইভাবে আবার তার কৃতকর্মের বিচার কার্য হবে, পুনরায় তাকে আবার কর্মের ফলাফল হিসেবে সৃষ্টি করা হবে তখন সে কোনো আকৃতি প্রাপ্ত হবে, এটা নির্ভর করছে তার কর্মের ফলাফলের উপর। অর্থাৎ কেউ যদি মানুষ হয়ে পশুর মত কর্ম করে তাহলে তাকে মানুষের স্তর থেকে পশুর স্তরে অর্থাৎ নিম্ন স্তরে নামিয়ে দেওয়া হবে। তখন সে আর মানব আকৃতি পাবে না। তাকে সৃষ্টি করা হবে পশু আকৃতিতে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "তোমাকে সুন্দর আকৃতির অনুকরণে সৃষ্টি করেছি, কিন্তু কর্মফলে আবার তোমাকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতায় পরিণত করি।" (সূরা-ত্বীন, আয়াত-৪ ও আয়াত-৫)। অর্থাৎ কর্মদোষে কেউ জীব আকৃতি প্রাপ্ত হয়। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "তোমরা ঘৃণিত বানর হও।" (সূরা-বাকারা, আয়াত-৬৫)। অর্থাৎ যারা নিষিদ্ধ কার্য করবে, তাদেরকে ঘৃণিত বানর করে সৃষ্টি করা হবে। (সূরা-আরাফ, আয়াত-১৬৬)। এমনই ভাবে তারা যে মানব রূপে ছিল, তারা হয়ত কর্মদোষে কেউবা পশু হবে আবার কেউবা তাদের স্থলে তাদের সাদৃশ্য মানব হবে অন্য আকৃতিতে। যা তাদের অজানা। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "তাদের স্থলে তাদের সাদৃশ্য আনয়ন করা হবে এবং তাদেরকে এমন আকৃতি দান করা হবে যা তাদের জানা নেই।" (সূরা-ওয়াকিয়া, আয়াত-৬১)। তারা শুধু জানবে প্রথমে তার যে আকৃতি ছিল। (সূরা-ওয়াকিয়া, আয়াত-৬২)। এই ভাবে জীবনচক্রের মাধ্যমে শেষ বিচারের কঠিন শাস্তির পূর্বে লঘু শাস্তির মাধ্যমে সংশোধন করার সুযোগ দিয়ে থাকে। (সেজদা, আয়াত-২১)। এইভাবে ধাপে ধাপে তাকে উন্নতির দিকে আহরণ করে। (সূরা-৮৪, আয়াত-১৯)। যাতে মানুষ ইমান ও সৎ কর্ম অর্জনের মাধ্যমে অপরাধ থেকে ফিরে আসতে পারে। এইভাবে প্রত্যেক জীবের মৃত্যু হবে এবং প্রত্যেক জীবই প্রভুর কাছে প্রত্যানীত হবে। (সূরা-আনকাবুত, আয়াত-৫৭)। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "আমি প্রত্যেক জীবকে মৃত্যু ঘটাই এবং ভাল মন্দ বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই নিকট পুনরায় প্রত্যানীত করি।" (সূরা-আম্বিয়া, আয়াত-৩৫)। এইভাবে মানুষের সৃষ্টি ও পুনঃজীবিতকরণ প্রক্রিয়া ও একটি জীবজন্তুর সৃষ্টি ও পুনঃজীবিতকরণ প্রক্রিয়া একই রকম। (সূরা-৩১, আয়াত-২৮)। আত্মীকরণের ক্ষেত্রে পশু এবং মানব আত্মার কোনো ভেদাভেদ নেই কারণ পশু আত্মা ও মানব আত্মার মধ্যে ভিন্নতা আছে মর্মে কোনো আয়াত পবিত্র কোরআনে আসে নি, কাজেই সকল জীবই এক আত্মা তথা সকল জীবেরই মৃত্যু হবে (সূরা-আনকাবুত, আয়াত-৫৭) এবং সকল জীবেই প্রভুসত্তা রুহুরূপে বিরাজমান। (সূরা-বনি ইসরাইল, আয়াত-৮৫)। তাই এক জীব থেকে অন্য জীবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে কখনও-বা মানুষ কখনও-বা পশু কখনও অপূর্ণাঙ্গ মানুষÑ এই কবি নজরুল বলেছে 'মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম' তিনি আরও বলেছেনÑ 'কেমন করে ঘুরছে মানুষ, যুগান্তরে ঘুরণি পাকে'।
এমনই ভাবে জীবজগৎ পর্যায়ক্রমে আবর্তনের মাধ্যমে "সৃষ্টিতে এনে পুনরাবর্তন ঘটানো হচ্ছে।" (সূরা-ইউনুস, আয়াত-৪)। (সূরা-২৭, আয়াত-৬৪)। (সূরা-৮৫, আয়াত-১৩)। কারণ এজন্য পৃথিবীর কোনো কিছু আল্লাহ নিরর্থক সৃষ্টি করেন নি। (নং-১৪, আয়াত-৮৬)। তাই কর্ম অনুসারে শাস্তি বিধান রাখা হয়েছে। বিধায় কেউবা জন্মসূত্রে অন্ধ, কেউবা বোবা, কেউবা লেংড়া, কেউবা পঙ্গু, কেউবা রোগাগ্রস্ত, কেউবা হতদরিদ্র, কেউবা অভিশপ্ত। এই গুলি সবই তার পূর্ব কর্মের ফল সে এই জন্মে ভোগ করছে। এটাই তার পূর্ব কর্মের জন্য শাস্তি বা আজাব বা অগ্নি। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, পৃথিবীতে তোমাদের উপর যে বিপর্যয় আসে পূর্বেই উহা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। (সূর হাদীদ : ২২) কারণ আল্লাহ কারো প্রতি যুলুম করেনা। (সূরা-১৮, আয়াত-৪৯)। আর তাই তারা পূর্ব জন্মের নিজ কর্মদোষেই তারা শাস্তি প্রাপ্য। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, পৃথিবীতে যত বিপদ আপদ ঘটে তা তার কর্মের কারণেই ঘটে। (সূরা-৪২ শুরা, আয়াত-৩০)। মানুষের যত অকল্যাণ হয় তা তার নিজ কর্মের কারণেই হয়। (সূরা নেসা : ৭৯) এই সকল বিপদ আপদ ও শাস্তি তার জন্য জাহিম বা অগ্নিস্বরূপ। যা তার জন্য শৃঙ্খলস্বরূপ নির্দিষ্ট যা তার মৃত্যু পর্যন্ত, অর্থাৎ মৃত্যুর পরে পুনঃজীবিত হওয়া পর্যন্ত। এটাই আলমে বরযখ বলা হয়েছে। (সূরা-২৩, আয়াত-১০০)। এইভাবে জীবকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, এই দর্শনে যারা বিশ্বাসী তারা অবশ্যই জাহিম বা অগ্নির শাস্তি দেখতে পাবে। (সূরা-১০২, আয়াত-৬)। এই দেহের মাধ্যমে তাকে শৃঙ্খলিত করে কোনো এক সংকীর্ণ স্থানে তাকে নিক্ষেপ করা হবে। (সূরা-ফুরকান, আয়াত-১৩)। অপরাধীরা থাকিবে শৃঙ্খলিত অবস্থায় (সূরা-১৪, আয়াত-৪৯)। (সূরা-১৩, আয়াত-৫)। এই ভাবে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে মর্মে আল্লাহ বলেন, "তোমাদের হিসাব নিকাশের দিন আসন্ন।" (সূরা-আম্বিয়া, আয়াত-১)। জীব দেহ থেকে জীবকে সৃষ্টি করা হয়েছে, আবার তাকে মৃত্যুর পরে জীব দেহের মধ্য দিয়েই সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, আবার তাকে জীবদেহের মাধ্যমেই উঠানো হচ্ছে, এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "তিনি তোমাকে মৃত্তিকা হতে (তথা জীবদেহ হতে) উদ্ভুত করেন।" (সূরা-৭১, আয়াত-১৭)। আবার তিনি তাতেই তোমাদেরকে প্রত্যানয়ন করবেন, অর্থাৎ জীবদেহের মাধ্যমে পুনরাবর্তন ঘটান। আবার উহা (অর্থাৎ জীবদেহ থেকেই সন্তান হিসেবে) বের করবেন। (সূরা-৭১, আয়াত-১৮)। এভাবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে ইমান ও কর্মফল মুহূর্ত অনুসারে জীবন চক্র ঘটান। শেষ বিচারের দিন আগত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। অর্থাৎ যখন প্রথমবার শিংগায় ফুৎকার দিবেন, আসমান ও যমিনের যা কিছু আছে সকলে মূর্ছা যাবে অর্থাৎ মৃত্যু হবে (সূরা-৩৯, আয়াত-৬৮) তখন সকল কিছু ধ্বংস হবে (সূরা-৬৯, আয়াত-১৪)। সকল কিছু ধ্বংস হবে একমাত্র প্রভু স্বত্তা ব্যতীত (সূরা-কাছাস, আয়াত-৮৮)। অর্থাৎ সকলের মৃত্যু হবে এবং মৃত্যুর পরই সকলেই কবরস্থ হবে (সূরা-৮০, আয়াত-২১)। দ্বিতীয়বার শিংগায় ফুৎকার দিলে সকলেই উঠে দাঁড়াবে (জুমার, আয়াত-৬৮)। দ্বিতীয়বার শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে তখন দেহে আত্মার সংযোজন করা হবে (তাকবীর, আয়াত-৭)। তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। (আবাসা, আয়াত-২২)। কবর উন্মোচিত করা হবে। (ইনফিতর, আয়াত-৪)। কবর থেকে উত্থিত হবে। (আদিয়াত, আয়াত-৯)। কবর থেকে বের হবে দ্রুত বেগে। (মাআরিজ, আয়াত-৪৩)। কবর থেকে বের হবে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের ন্যায়। (কামার, আয়াত-৭)। তখন কবর থেকে উঠে প্রভুর দিকে ছুটতে থাকবে। (সূরা-হজ, আয়াত-৭)। (সূরা-৩৬, আয়াত-৫১)। এখানে কবর বলতে প্রথম শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার পর থেকে দ্বিতীয় শিংগায় ফুৎকার দেওয়া পর্যন্ত এই নির্জীব অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। কারণ প্রথম শিংগায় ফুৎকার দিলে সকলের মৃত্যু হচ্ছে। আবার দ্বিতীয় শিংগায় ফুৎকার দিলে সকলে দ-ায়মান হচ্ছে (সুরা যুমার-৬৮)।
শেষ বিচারের মাধ্যমে কাউকে জান্নাত অথবা কাউকে জাহান্নাম দেয়া হবে। সেখানে তারা স্থায়ী হবে যতদিন পৃথিবী স্থায়ী থাকবে। কিংবা যতদিন প্রভু অন্যরূপ ইচ্ছা না করবে। (সূরা-হুদ, আয়াত-১০৬) এবং (সূরা-হুদ, আয়াত-১০৭)।
এটা কোরআনের দর্শন, কোরআনই দ্বীনের ক্ষেত্রে একমাত্র দলিল। মানব জাতীর জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দলিল ও নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য পথ নির্দেশ। (৪৫ সূরা-জাছিয়া, আয়াত-২০)। (সূরা-রাদ, আয়াত-৩৭)। আল্লাহর এই নিয়মের কোনো পরিবর্তন নেই (সূরার-রুম, আয়াত-৩০) এবং (সূরা-বণি ইসরাইল, আয়াত-৭৭)। পবিত্র কোরআনা দর্শনে জীবন বিধান প্রণয়ন করা আমাদের সকলের কর্তব্য।
বাদ্যযন্ত্র হারাম এ কথা কোরআনে উল্লেখ নেই
তোমরা আল্লাহকে এমনভাবে স্মরণ করবে, যেমন তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষগণকে স্মরণ করতে। (বাকারা, আয়াত-২০০)। অন্ধকার যুগে হজ সমাপনান্তে মিনার ময়দানে একত্রিত হয়ে কবিতা, লোক-গাঁথা ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের শৌর্য-বীর্য বর্ণনার প্রথা ছিল। (টীকা নং-১৪৭), (ইসলামি ফাউন্ডেশন, আল কুরআনুল কারিমের বঙ্গানুবাদ থেকে)। এখানে কবিতা শব্দ এসেছে আর কবিতার আরবি শব্দ হচ্ছে উনসুদাতু। আর উনসুদাতু শব্দের অর্থ হচ্ছে কবিতা, গান বা সংগীত। (আরবি অভিধান পৃ.-৫৬৪) অর্থাৎ পিতৃপুরুষগণের বিরহ বিচ্ছেদ তাদের অন্তরে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। লোকগাঁথা, ছন্দযুক্ত কথামালা, কবিতা তথা সংগীত এর মাধ্যমে সুরের লহরীতে সেই সুপ্ত বেদনা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে বেদনার সাগরে উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি করে আর তারা সেই তরঙ্গেই সন্তরণ করার মাধ্যমে পিতৃপুরুষগণের স্মরণে এক মাতম সৃষ্টি করে। যেমন ভাবে ফেরেস্তারা প্রভুর প্রেম তরঙ্গে সন্তরণের মাধ্যমে প্রভুর স্তুতিগান বা গুণকীর্তন করে থাকেন। (সূরা-বাকারা, আয়াত- ৩০)। (সূরা দাহর : ২৬) এই আয়াতে সাব্বিহু শব্দ এসেছে। সাব্বিহু শব্দের অর্থ সন্তরণ করা। (আরবি অভিধান পৃ. ১৪২৬)। অর্থাৎ ফেরেস্তারা প্রভুর প্রেম তরঙ্গে সন্তরণের মাধ্যমে প্রভুর স্তুতিগান বা গুণকীর্তন করে থাকে। অনেকেই বলেন উপরিউক্ত আয়াতদ্বয় অনুসারে স্তুতিগান বা লোকগাঁথা বা সংগীতের মাধ্যমে প্রভুর স্মরণ করা যাবে। তবে সে ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, শুধু লোক-গাঁথা, ছন্দযুক্ত কথামালা বা সংগীতের দ্বারা প্রভুর প্রেম তরঙ্গে সন্তরণের মাধ্যমে স্তুতিগান ও গুণ-কীর্তন করলে অন্তরে যে ভাবের উদয় হয়, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে তদপেক্ষা অভিনিবেশ সহকারে প্রভুর স্মরণের এক উচ্চমার্গে পৌঁছাতে সম্ভব হয়। ফলে তাদের ইমানের সাথে আরো ইমান বেড়ে যায় এভাবে যে, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে প্রভুর এস্কের সাথে আরো এস্ক বৃদ্ধি পায়। এভাবে তিনি মমিনদের অন্তরে প্রশান্তি দান করেন, যাতে তাদের ইমানের সাথে আরো ইমান বেড়ে যায়। (সূরা-ফাতহ, আয়াত-৪) তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে এস্কের সাথে এস্ক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ইমানের সাথে আরো ইমান বেড়ে যাচ্ছে ফলে তাদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল হয়, বিধায় তারা পূর্বের অপেক্ষা অর্থাৎ তদপেক্ষা অভিনিবেশসহকারে প্রভুর নাম স্মরণে একনিষ্ঠভাবে নিমগ্ন হতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে প্রভুর স্মরণে একনিষ্ঠভাবে তাতে নিমগ্ন হওয়া সম্ভব। আল্লাহ বলেন, তুমি তোমার প্রভুর নাম স্মরণ কর এবং একনিষ্ঠভাবে তাতে নিমগ্ন হও। (সূরা-মুজাম্মেল, আয়াত-৮)। প্রচলিত প্রক্রিয়ায় ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে প্রভুর নাম স্মরণে একনিষ্ঠভাবে নিমগ্ন হওয়া সম্ভব নয়। অথচ বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে প্রভুর প্রেমতরঙ্গে সন্তরণের মাধ্যমে যদি কেউ স্তুতিগান করে তাহলে সে প্রভুর নাম স্মরণে একনিষ্ঠভাবে নিমগ্ন হতে পারবে। উপরিউক্ত আয়াত অনুসারে যেহেতু প্রভুর নাম স্মরণে একনিষ্ঠভাবে নিমগ্ন হওয়া জরুরি আর বাদ্যযন্ত্র ছাড়া তা সম্ভব নয় বিধায় উপরিউক্ত আয়াত অনুসারে বাদ্যন্ত্রের ব্যবহার জরুরি। যে সকল সাধকগণের অন্তরে প্রভুর এস্কের অগ্নিময় জ্বালা সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করে তারা যখন বাদ্যযন্ত্রের দ্বারা সুরের লহরী তুলে প্রেম সাগরে সন্তরণের মাধ্যমে প্রভুর প্রেমের স্তুতিগানে নিয়োজিত হয় তখন এই সুপ্ত জ্বালাময় অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে অন্তরের সকল প্রকার আবিল্যকে দগ্ধিভূত করে প্রভুর এস্ক বহুগুণে বৃদ্ধি করে সাধককে এমন এক প্রেমময় অনাবিল শান্তির স্তরে পৌছে দেয় যা অন্য কোনো রেয়াযতের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এই বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশিষ্ট সাধক আল-ইমাম গাজ্জালী (র.) তাঁর প্রসিদ্ধ কিমিয়ায়ে সাদ্আত গ্রন্থের ২য় খ-ের সামা অধ্যায়ের ১৮০ পৃষ্ঠায় বিষদভাবে বর্ণনা করেছেন। এই স্তরে এসে সাধক প্রভুর প্রেমের যে স্বাদ বা অনুভূতি লাভ করে তা সাধারণত লিখে বা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। একমাত্র ভুক্তভোগী অভিজ্ঞ সাধক ছাড়া কেউ অনুভব করতে সক্ষম হবে না। এই মর্মে মওলানা রুমী (র.) তাঁর মসনবী শরিফে লিখেছেনÑ "ঝুলন্ত লতায় বসে মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া যে কি শান্তি, তা ছোট্ট বুলবুলি পাখি ছাড়া ঐ বাজপাখি কখনো তা বুঝতে পারে না।" কারণ বাজপাখি যেহেতু আকারে বড়, সেহেতু সে ঝুলন্ত লতায় বসতেই পারে না। আর তাই বাজপাখি তা কখনো বুঝতে পারেনা বিধায় বাজপাখিকে তা কখনো বুঝানো সম্ভব নয়। বিষয়টি এমন যে, একজন নপুংশ ব্যক্তিকে কখনোও কামতৃপ্তি সম্পর্কে ধারণা দেয়া সম্ভব না। তদ্রƒপ যাদের অন্তরে প্রভুর দর্শন নেই, প্রভুর এস্ক নেই, প্রভুর বিচ্ছেদের যন্ত্রণা নেই, তাদেরকে বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে স্তুতিগানের মাধ্যমে সৃষ্ট আবেগময় অনুভূতিকে বুঝানো সম্ভব নয়। এটা একটা বাস্তবমুখী অধ্যায়। যা সাধক তার সাধনার কোনো এক স্তরে পৌঁছে অনুভব করে থাকে। এই মর্মে পাক-ভারত উপ-মহাদেশের শ্রেষ্ঠ সাধক হিন্দেল অলী আতায়ে রসূল গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্ত (আজমীরি) (র.)-এর সামার মাহফিলে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
অনেকেই বলে প্রভুর স্মরণে নিমগ্ন হতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হারাম। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, বাদ্যযন্ত্র হারাম মর্মে কোনো আয়াত পবিত্র কোরআনে আসে নি। এখানে উল্লেখ্য যে, যন্ত্রের আরবি শব্দ হচ্ছে 'আলাতুন' (আরবি অভিধান, পৃষ্ঠা-৪৬৬)। আর বাদ্যযন্ত্রের আরবি শব্দ হচ্ছে 'আলাতুন মুশকিয়াতুন' (আরবি-বাংলা- ইংরেজি অভিধান, পৃ. ৫০৬)। স্বয়ং আল্লাহ বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করে নি, তারপরও যদি কেউ বাদ্যযন্ত্রকে হারাম জেনে থাকেন তাহলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার সামিল হয়। কারণ দ্বীনের বিষয়ে এই কোরআনই স্পষ্ট দলিল। (সূরা-জাছিয়া, আয়াত-২০)। (সূরা-রাদ, আয়াত-৩৭ )। পবিত্র কোরআনই দ্বীনের বিষয়ে পরিপূর্ণ। (সূরা-মায়েদা, আয়াত-৩)। আর আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী সবচেয়ে বড় জালিম। (সূরা-হুদ, আয়াত-১৮)। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেকেই বলে থাকেন যে, বাদ্যযন্ত্র হারাম কথাটা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ নেই, কিন্তু বাদ্যযন্ত্র যে হালাল সেটা কোনো আয়াতে উল্লেখ আছে? সে প্রসঙ্গে বলছি, আল্লাহর সকল হালাল সৃষ্টির নাম কোরআনে উল্লেখ করতে গেলে কোরআনের কলেবর বৃদ্ধি পায় কারণ হালাল বস্তুর সংখ্যা অধিক। পক্ষান্তরে হারাম বস্তুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম বিধায় আল্লাহ এই মর্মে বলেন, আমি যা হারাম করেছি তা ব্যতীত যাবতীয় বিষয়ই হালাল। (ইমরান, আয়াত-৯৩)। যেহেতু বাদ্যযন্ত্র হারাম মর্মে পবিত্র কোরআনে কোনো আয়াত নেই বিধায় এই আয়াত অনুসারে বাদ্যযন্ত্র হালাল এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর হালাল বস্তুকে হারাম জানিও না। (মায়েদা, আয়াত-৮৭)। আমাদের মূল আলোচনা হচ্ছে সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রযোজ্য কি না? এই মর্মে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ইবলিস মানুষের মধ্যে নফসানী প্রবণতাকে বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রভুর এস্কের বিপরীতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করে মানুষকে দুনিয়াবী মোহে মত্ত রাখে, তাই বর্তমান সমাজের মানুষ এই বাদ্যযন্ত্রের অপব্যবহার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বিধায় প্রভুর এস্কের দিকে মানুষকে ফিরিয়ে আনতে আমাদেরকেও ইসলামি সাংস্কৃতি তথা ইসলামি সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বা প্রয়োগ ঘটাতে হবে। অর্থাৎ ইসলামি সংগীত বা সামার মাধ্যমে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ঘটিয়ে মানুষকে প্রভুর এস্কের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, তোমরা যেভাবে আক্রান্ত হও, সেভাবেই তা প্রতিহত কর। (বাকারা, আয়াত-১৯৪)। তা ছাড়াও যুদ্ধক্ষেত্রে কাফেরদের বিপক্ষে মমিনদেরকে একনিষ্ঠ করে সুশৃৃঙ্খলভাবে আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছিল। বাদ্যযন্ত্র হারাম বা অপবিত্র হলে মহানবী (স.) যুদ্ধক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ প্রেমিক তথা আধ্যাত্মিক সাধকদের ইসলামি সংগীত তথা সামা পাঠের মজলিশে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার অধিক ফলপ্রসূ। এই পর্যায়ে এসে কিছু লোক এমনও বলে থাকেন যে, শুধু আল্লাহর প্রেমিক সাধক পুরুষগণ ব্যতীত দুনিয়াবী মোহে মত্ত সাধারণ কোনো ব্যক্তি সাধকদের ঐ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারযুক্ত ছামার মাহফিলে উপস্থিত থাকতে পারবে না। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, একটি ফুল বাগানে শুধু ফুল দিতে সক্ষম এমন গাছ রেখে বাকি সকল চারা গাছ যদি কর্তন করা হয়, তাহলে একসময় বাগানটি ফুলশূন্য হয়ে যাবে। কারণ ফুল দিতে সক্ষম গাছগুলো একসময় ফুল দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। তাই আজকের চারা গাছটা বাগানে স্বযতেœ রাখতে হবে এজন্য যে, একসময় এরাও ফুল দিবে, তদ্রƒপ সাধকের সামার মাহফিলে সাধারণ মানুষও উপস্থিত থাকবে, কারণ একসময় এরাও আল্লাহর প্রেমিক সাধকদের সংস্পর্শে এসে প্রভুর প্রেমিক হবে। তাই সর্বসাধারণের জন্য ইসলামি সংগীত অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার জায়েয এতে কোনো সন্দেহ নেই।