সোমবার, ২৮ জুন, ২০২১

আঠারো মোকামের নাম

 ১৮ মোকামের নাম।কথায় আছে,আঠারো মোকাম খবর যার কাছে আছে,মানব তো দূরের কথা দেব লোকেও তারে মানে।


১.মোকামে মাহমুদা

২.মোকামে ইব্রাহীম

৩. মোকামেসুলতানুল নাসিরা

৪.মোকামে মুওয়াহেদ

৫.মোকামে ওরাইল ওরা

৬.মোকামে আরওয়াহ

৭.মোকামে মাসুদ

৮.মোকামে নাছুত

৯.মোকামে মলকুত

১০.মোকামে জবরুত

১১.মোকামে লাহুত

১২.মোকামে হাহুত

১৩.মোকামে লা

১৪. মোকামে হা

১৫. মোকামে বেল ফেল

১৬.মোকামে নাসি

১৭.মোকামে খায়ের নাসি

১৮. মোকামে বেল কুয়া।


এছাড়াও আর একটি মোকাম আছে,যে মোকামে নুরের দেহ থাকে,যাকে মোকামে ছনিয়া বলে।মা আমেনার এই মোকামে আমার নুর নবী ছিলেন।

সোমবার, ৭ জুন, ২০২১

কবরের আযাব ও জন্মান্তরবাদ

কবরের আযাবের কথা কোরআনে উল্লেখ নেই

মৃত্যুর পরের জগৎটা আখেরাত তথা গায়েব জগত। আর এই গায়েব জগত সম্পর্কে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে। (সূরা-বাকারা, আয়াত-১)। প্রভুর সকল গায়েব বিষয়ে ভয় করতে বলা হয়েছে। (সূরা-ইয়াছিন, আয়াত-১১)। আল্লাহ ছাড়া এই গায়েব জগতের জ্ঞান কারো নেই। (সূরা-নামল, আয়াত-৬৫)। (সূরা-ইউনুস, আয়াত-২০)। আল্লাহর কথা একমাত্র কোরআন, আর কোরআন থেকেই গায়েব জগতের বিষয়গুলো আমাদের জানতে হবে। নবী (স.) গায়েব সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না (সূরা আনআম : ৫০) (সূরা-আরাফ, আয়াত-১৮৮)। বিধায় নবী (স.) ওহী ব্যতীত (দ্বীনের কোনো বিষয়ে তথা গায়েব বিষয়ে) কাউকে সতর্ক করেন নি (সূরা-আম্বিয়া, আয়াত-৪৫)। কাজেই গায়েব জগত সম্পর্কে আমাদের একমাত্র কোরআন মোতাবেক ই জানতে হবে ও বিশ্বাস করতে হবে।পবিত্র কোরআনে নেই এমন কথা যদি কেউ হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে গায়েব জগতের সম্বন্ধে বলে থাকেন তাহলে সেটা অবশ্যই পরিহারযোগ্য। যেমন হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে অনেকেই বলেন কবরে ইমান পরীক্ষা করার জন্য নিন্মলিখিত প্রশ্নগুলি করা হবেঃ (১) মান রাব্বুকা- অর্থাৎ তোমার প্রভু কে? (২) মান দ্বীনুকা- অর্থাৎ তোমার দ্বীন কি? (৩) মান হাযা রাজুলুন অর্থাৎ এই ব্যক্তি কে? কিন্তু দুখের বিষয় এই ৩টি প্রশ্ন করে কবরে ইমান পরীক্ষা করা হবে এমন কথা পবিত্র কোরআনে কোনো আয়াতে উল্লেখ নেই। তাছাড়াও উক্ত তিনটি প্রশ্ন দিয়ে কবরে ইমান পরীক্ষা করা হলে ইবলিস এবং ইবলিসের অনুসারীরা ইমান পরীক্ষায় পাশ করে পরিত্রাণযোগ্য বলে গণ হয়ে যায়। কারণ ইবলিসের অনুসারীগণও উক্ত ৩টি প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। কারণ যখন কবরে তাদের প্রশ্ন করা হবে- মান রাব্বুকা, তখন ইবলিসের অনুসারীগণ বলবে আমার প্রভুত আল্লাহ, কারণ ইবলিস ত আল্লাহকে প্রভু বলে স্বীকার করে। (সূরা-হিযর, আয়াত-৩৬)। যখন বলা হবে তোমার দ্বীন কি? তখন তারা বলবে- আমার দ্বীন ইসলাম। কারণ (আসমান যমিনের সকলেই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে)। (সূরা-ইমরান, আয়াত-৮৩)। যখন (নবী (স.) কে দেখিয়ে) প্রশ্ন করা হবে মান হাজা রাযুলুন - এই লোকটি কে? তখন তারা বলবে উনি নবী মোহাম্মদ (স.)। কারণ তৎকালীন সময়ের ইবলিসের অনুসারী কাফেররা নবী (স.) কে দেখেছে ও চিনেছে। তাহলে দেখা গেল উক্ত তিনটি প্রশ্নের উত্তর ইবলিস ও ইবলিসের অনুসারীরা দিতে সক্ষম হয়ে যায় বিধায় তারা পরিত্রাণযোগ্য বলে গণ্য হয়। কিন্তু না, ইবলিস ও ইবলিসের অনুসারীরা পরিত্রাণ পাবে না। বিধায় উপরিউক্ত ৩টি প্রশ্ন দিয়ে মৃত্যুর পর ইমান পরীক্ষা করা হবে না, এটা নিশ্চিত।
তাছাড়াও আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, কবরের আযাব সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে কোনো আয়াতে উল্লেখ নেই। তারপরও যদি কেউ বলে সকল অপরাধীদের জন্যই কবরের আযাব হবে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, ধরুন, প্রথম শিংগায় ফুৎকার দেওয়র পর একজন ব্যক্তির মৃত্যু হলো (সূরা-জুমার, আয়াত-৬৮)। তার পরে ২য় শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নির্জীব কবরস্থ রহিল। ২য় শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার পর সে দন্ডায়মান হইল। (সূরা-জুমার, আয়াত-৬৮)। অর্থাৎ ২য় শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার পর তার দেহে আত্মা সংযোজন করা হলো। (সূরা-তাকভীর, আয়াত-৭)। এইভাবে তাকে কবর থেকে পুনরুজ্জীবিত করা হইল। (সূরা-আবাসা, আয়াত-২২)। তখন তার কবর উন্মোচিত করা হইল। (সূরা-ইনফিতর, আয়াত-৪)। (সূরা-হজ, আয়াত-৭)। (সূরা-আদিয়াত, আয়াত-৯)। এবং তখন কবর থেকে উঠিয়া সকলে প্রভুর দিকে দৌড়াইতে থাকিবে। (সূরা-ইয়াছিন, আয়াত-৫১)। (সূরা-মাআরিজ, আয়াত-৪৩)। যেন তারা পঙ্গপালের মত কবর থেকে বাহির হতেছে। (সূরা-ক্বামার, আয়াত-৭)। তারপর শেষ বিচার শুরু হবে, এই বর্ণনা মোতাবেক রোজ কেয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে যারা মারা গেল তাদের তো কবরে কোনো আযাবের বর্ণনা এখানে আসে নি। কারণ কবর থেকে জীবিত হওয়ার পরওতো বিচারের জন্য চলে গেল। তাদের জন্যতো কবরে জীবিত করে উক্ত ৩টি প্রশ্ন করা হইল না কিংবা তাদের কবরে কোনো শাস্তির বিষয়ে উল্লেখ নেই। তাহলে দেখা গেল ১ম শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে যিনি মারা গেলেন তাকে আর কবরের আযাব ভোগ করা লাগল না। পক্ষান্তরে (প্রচলিত ধর্ম দর্শন মোতাবেক) যখন আদম (আ.) এর একজন সন্তান সে সময় সে মারা গেল এবং কবরস্থ হলো, এবং তাকে কবর থেকে পুনজ্জীবিত করে উক্ত ৩টি প্রশ্নের মাধ্যমে ইমান পরীক্ষা করতঃ সে যথার্থ উত্তর দিতে না পারায় তার কবরের আযাব শুরু হয়ে গেল এবং ১ম শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার দিন পর্যন্ত আযাব ভোগ করল, তাহলে আল্লাহ পাকের নিয়মের বৈষম্যের কারণে একজন দীর্ঘদিন কবরের আযাব দ্বারা আক্রান্ত হইল আর একজন রোজ কিয়ামতের দিন মারা গেল, তিনি কবরের আযাব ছাড়াই সেদিন প্রভুর কাছে দন্ডয়মান হইল। সেক্ষেত্রে আল্লাহর নিয়মের বৈষম্যতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু না আল্লাহ পাকের নিয়মের কোনো পরিবর্তন নেই। (সূরা-বণি ইসরাইল, আয়াত-৭৭)। কারণ সকল বনি আদমের যাত্রা একই সময় থেকে শুরু এই মর্মে আল্লাহ বলেন, 'আমি কি তোমাদের প্রভু নহি'? তখন সকলেই স্বীকার করল, হ্যাঁ, আপনিই আমাদের প্রভু।(সূরা-আরাফ, আয়াত-১৭২)। আর সেই থেকেই জীব জগৎ শুরু। যিনি প্রথম শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার মুহূর্তে মারা গেল, তার যাত্রাও শুরু হয়েছিল ১ম থেকেই। সে জন্ম জন্মান্তরে বিভিন্ন জনমে শাস্তি ভোগ করে সেই দিন পর্যন্ত পৌঁছেছে বিধায় সকলের জন্য একই নিয়ম বা পদ্ধতি। আর সেটাই হচ্ছে জন্মান্তরবাদ পদ্ধতিতে আলমে বরযখে শাস্তি প্রদান। আসলে কবর বলতে মৃত্যুর পর হতে পুনর্জীবিত হওয়া পর্যন্ত এই নির্জীব অবস্থাকে বলে। অর্থাৎ মৃত্যুর পরের অবস্থা কবর। (সূরা-আবাসা, আয়াত-২১)। এর পর আল্লাহ যখন ইচ্ছা তাকে পুনরুজীবিত করেন। (সূরা-আবাসা, আয়াত-২২)। তাহলে বুঝা গেল মৃত্যুর পর কিছুটা সময় নির্জীব অবস্থায় থাকছে। আর এটাকেই কবর বলা হচ্ছে যেহেতু নির্জীব অবস্থায় কোনো কিছু ইমান পরীক্ষা করা বা শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। বিধায় কবরে ইমান পরীক্ষা করা ও আযাবের ঘটনা ভিত্তিহীন। কারণ যেহেতু মৃত্যুর পরে কবর থেকে পুনঃজীবিত করা হচ্ছে, তাহলে পুনঃজীবিত করার পরে সে আর কবরে থাকছে না। কারণ পুনঃজীবিত করে তাকে প্রভুর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে (সূরা-আনাম, আয়াত-৩৬)। সেখানে ইমান পরীক্ষা করার পরে পুনরায় তাকে কবরে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না বিধায় এতে প্রমাণিত হয় যে, কবরে কোনো ইমান পরীক্ষা করা ও আযাব দেওয়া কোনটাই হচ্ছে না। এখানে উল্লেখ্য যে, মৃত্যুর পর পরই তাকে পুনঃজীবিত করে প্রভুর কাছে প্রত্যান্যিত করা হচ্ছে, তখন তার ইমান ও পূর্বকর্ম পরীক্ষা করার পর তার কর্মের প্রতিদান প্রদান করা হবে। (সূরা-হুদ, আয়াত-১১১)। এই লক্ষ্যে তাকে নতুন ভাবে সৃষ্টি করে পুনরায় সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। (সূরা-আরাফ, আয়াত-২৯)। (বিঃ দ্রঃ- এই পুস্তকে জন্মান্তরবাদ অধ্যায়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন) এই ভাবে পুনঃ সৃষ্টির মাধ্যমে তাকে পূর্ব জনম থেকে আড়াল করা হবে, যাতে সে পূর্ব জনমের কোনো স্মৃতি স্মরণ করতে না পারে। এই জন্য আল্লাহ বলেন, 'তাদের সম্মুখে বরযখ থাকিবে পুনঃজীবিত হওয়ার দিন পর্যন্ত' (সূরা-মমিনুন, আয়াত-১০০)। এই আয়াতে বরযখ শব্দ এসেছে, বরযখ শব্দের অর্থ দুই বস্তুর মধ্যস্থিত প্রতিবন্ধকতা। অর্থাৎ পূর্ব জনম ও পরবর্তী জনম এর মধ্যে একটি প্রতিবন্ধকতা। (আরবি অভিধান পৃ. ৬৭১)। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেকের ধারণা বরযখ বলতে কবরকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু না, কবর শব্দ এবং বরযখ শব্দ দুইটিই আরবি শব্দ। আর এই দুইটি শব্দই পবিত্র কুরআনে এসেছে। কবর শব্দ এসেছে সূরা তওবার ৮৪ নং আয়াত থেকে, আর বরযখ শব্দ এসেছে সূরা মমিনুন আয়াত-১০০ থেকে (সুরা রহমান-১৯)। দুইটি শব্দ, দুইটি আয়াত, আর দুইটি আয়াতের দুইটি উদ্দেশ্য, অর্থও দুইটি। কবর শব্দের অর্থ হচ্ছে নীচু ভূমি বা সমাধি (আরবি অভিধান পৃ. ১৯১৯ )। তাহলে দেখা গেল কবর ও বরযখ শব্দের অর্থ এক নয়। সে ক্ষেত্রে যদি কেউ বরযখ শব্দ দিয়ে কবরকে বুঝায় তাহলে বরযখ শব্দের যে আয়াত সেই আয়াতের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। সূরা মমিনুন আয়াত-১০০ এর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। আল্লাহর কোনো আয়াতকে ব্যর্থ করা যাবে না। (সূরা-হজ, আয়াত-৫১)। কাজেই বরযখ শব্দ দিয়ে কবরকে বুঝানো যাবে না। এখানে উল্লেখ্য যে, ইমান পরীক্ষার পরে তার প্রতিদান প্রদান করার লক্ষ্যে আলমে বরযখে পাঠানো হচ্ছে, (সূরা মমিনুন আয়াত-১০০) এখানে উল্লেখ্য যে, যেহেতু এই আয়াতে কবরের কথা উল্লেখ নেই, তাতে প্রমান হয় যে, কবর থেকে পুনঃজিবীত করে প্রভুর কাছে নিয়ে গিয়ে ঈমাণ পরীক্ষার পর তাকে আর কবরে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না, যদি কবরে ফেরত পাঠানো হতো তাহলে উক্ত আয়াতে 'তোমাকে বরযখে রাখা হবে' এ কথাটি না বলে 'তোমাকে কবরে রাখা হবে, পরবর্তী পুনঃজীবিত হওয়ার দিন পর্যন্ত' কিন্তু এমনটি বলা হয় নি বিধায় প্রমাণিত হয় যে, তাকে আর কবরে পাঠানো হয় নি। তাই কবরে কোনো আযাব বা শাস্তি কিছুই হচ্ছেনা, বরং কবর একটি নির্জীব অবস্থা। তা ছাড়া যখনই পুনঃজীবিত করা হচ্ছে, তখন সে আর কবরে থাকছে না। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেকেই বলবে মৃতুর পরে পুনঃজীবিত করে যখন আল্লাহর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন কোনো শরীরে নিয়ে যাওয়া হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ঊাবৎু ড়হবং যধং ঃড়ি নড়ফু, ঙহবং ঢ়যুংরপধষ নড়ফু, ড়ঃযবৎং ধংঃৎধষ নড়ফু. প্রত্যেকের দুইটি দেহ, একটি শারিরীক ও অপরটি হচ্ছে আত্মীক দেহ বা জতিষ্ময় দেহ। মৃত্যুর পর প্রভুর কাছে শারিরীক দেহ তথা ঢ়যুংরপধষ নড়ফু যাচ্ছে না এটা ধ্বংসশীল। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে এটা ধ্বংস হয়ে যায়। কতটা পানিতে কতটাবা মাটিতে, কতেকটা বাষ্পীয়ভাবে ধবংস হয়। মৃত্যুর পরে পুনঃজীতিব করে ধংঃৎধষ নড়ফু বা আত্মিক দেহে তাকে প্রভুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। যেমনটি আমরা নিদ্রা নামে মৃত্যুর সময় কিছুটা বুঝতে পারি। কারণ নিদ্্রাটাও এক প্রকার মৃত্যু। (সূরা-জুমার, আয়াত-৪২)। (সূরা-আনআম, আয়াত-৬০)। নিদ্রার সময় রুহুটা শারিরীক দেহে বিছানায় থেকে যায়, আর নফসটা আত্মিক দেহ ধারণ করে বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করে। ইসলামি ফাউন্ডেশন টিকা নং- ১৫০১। ঠিক মৃত্যুর পরে মানুষের শারিরীক দেহটা ধ্বংস হয়ে যায় আর তাকে পুনঃজীবিত করে তার আত্মিক দেহটা প্রভুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।( সূরা-আনআম, আয়াত-৩৬)। এখন আমরা জানব কিভাবে মানুষের ইমান পরীক্ষা করা হয়। প্রত্যেক জীবের মৃত্যুর পর পুনঃজীবিত করে তাকে প্রভুর কাছে প্রত্যানিত করা হবে। সূরা-আনআম, আয়াত-৩৬)। (সূরা-সেজদা, আয়াত-১১)। সূরা-(আনআম, আয়াত-৬২)। তখন তার সম্মুখ থেকে সকল পর্দা উন্মোচিত হবে এবং তার দৃষ্টি প্রখর করা হবে (সূরা-কাফ, আয়াত-২২)। তখন প্রভুর দিকে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে (সূরা-কিয়াম, আয়াত-২৩)। সেদিন কাফিররাও স্পষ্টভাবে আল্লাহকে দেখতে পাবে। (সূরা-মরিয়ম, আয়াত-৩৮)। তখন বলা হবে মৃত্যুর পুর্বে তোমরা যা কিছু (দেখিতে) কামনা করতে আজ সব দেখলেতো? (সূরা-ইমরান, আয়াত-১৪৩)। তখন তারা বলবে আমরা সব দেখলাম এবং শুনলাম এবং প্রভুকে বিশ্বাসও করলাম। (সূরা-(সেজদা, আয়াত-১২)। তখন বলা হবে তোমাদের আজকের বিশ্বাস কবুল করা হবে না (সূরা-সেজদা, আয়াত-২৯)। তবে যারা পূর্ব থেকে (এহেন দেখে) বিশ্বাসী ছিল তাদেরটা বিশ্বাস কবুল করা হবে। (সূরা-আনআম, আয়াত-১৫৮)। তখন তারা আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি প্রদর্শন করবে। (সূরা-নাহল, আয়াত-১১১)। এবং বলবে হে প্রভু আমরাতো পূর্ব থেকেই বিশ্বাসী ছিলাম। (সূরা-সেজদা, আয়াত-১২)। তখন বলা হবে, তোমরা বিশ্বাসী ছিলে বললেই তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না ইমান পরীক্ষা না করে। (সূরা-আনকাবুত, আয়াত-২)। শুধু মৌখিক ইমান পরীক্ষা করবে না, বরং ইমান অনুসারে পূর্ব কর্ম পরীক্ষা করা হবে। (সূরা-ইউনুস, আয়াত-৩০)। আর এমন একটি কঠিন পরীক্ষা করা হবে, যে পরীক্ষায় কারা প্রকৃতপক্ষে ইবলিসের অনুসারী ছিল, তারা ধরা পড়বে। (সূরা-কালাম, আয়াত-৬)। আর সেই পরীক্ষাটি এমন ্একটি কঠিন পরীক্ষা হবে যে, সেথায় শুধু যালিমরাই আক্রান্ত হবেনা (বরং নামধারী, লেবাসধারী মমিনরাও আক্রান্ত হবে।) (সূরা-আনফাল, আয়াত-২৫)। তখন আকৃতি বিশিষ্ট আল্লাহর পায়ে সেজদা দিতে বলা হবে, তখন তারা সেজদা দিতে সক্ষম হবে না।(সূরা-কালাম, আয়াত-৪২)। কারণ যখন তারা নিরাপদ ছিল, তখন তাদেরকে আহ্বান করা হয়েছিল ঐ সেজদা করতে, (অর্থাৎ আকৃতি বিশিষ্ট আল্লাহর পায়ে) তখন তারা ঐ সেজদা করে নি। (সূরা-কালাম, আয়াত-৪৩)। এইভাবে আল্লাহর পায়ে সেজদার মাধ্যমেই তার পরীক্ষা করেই ইবলিস এবং ইবলিসের অনুসারীদেরকে প্রতিহত করা হবে। কারণ ইবলিসতো আদম কাবায় সেজদা না দিয়েই কাফের। (সূরা-বারাকা, আয়াত-৩৪)। তখন তাদেরকে কর্মফল অনুসারে প্রতিদান দেওয়া হবে। (সূরা-হুদ, আয়াত-১১১)। এই লক্ষে তাদেরকে পুনরায় সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হবে। প্রথম বার যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল। (সূরা-আরাফ আয়াত-২৯)। এভাবে জন্ম জন্মান্তরে চলতে থাকবে। (এই বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন, এই পুস্তকের জন্মান্তরবাদ অধ্যায়ে।) এইভাবে সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তাদের কর্মের প্রতিদান দেওয়া হবে। বিনাদোষে কেউ শাস্তি পেতে পারে না। তবে পুনঃসৃষ্টির এই জীবনটায় পূর্ব জন্ম থেকে অন্তরালে। আর এই জগৎটাকে আলমে বরযোখ বলা হয়। আর তাই আযাবটা কবরে নয় বরং আলমে বরযোখে।
অতএব, সেই দিবস আসার পূর্বেই অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বেই প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আদম কাবায় সেজদা দিয়ে মৃত্যু বরণ করতে হবে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, সেই দিবস আসার পূর্বেই তোমরা প্রভুর আহ্বানে সাড়া দাও। (সূরা-শুরা, আয়াত-৪৭)। কাজেই কোরআন মোতাবেক যারা আখেরাত বিশ্বাস করেনা, বরং হাদিস অনুসারে বিশ্বাসী ছিল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ যারা কোরআন মাফিক আখেরাত বিশ্বাস করে না তারা মমিন ছিলনা। বিধায় তারা ক্ষতির ভিতর নিমজ্জিত। (সূরা-আছর, আয়াত-১)।

ইসলামে জন্মান্তরবাদ

শুক্রবিন্দু হতে আল্লাহ মানব সৃষ্টি করেন পরে তাকে পরিমিত বিকাশ সাধন করেন। (নং-৮০, আয়াত-১৯)। অতঃপর তার পথ সহজ করে দেন (নং-৮০, আয়াত-২০)। অতঃপর তার মৃত্যু ঘটান এবং তাকে কবরস্থ করেন। (নং-৮০, আয়াত-২১)। অতঃপর যখন ইচ্ছা তিনি তাকে সজীব (পুনঃজ্জীবিত) করেন। (নং-৮০, আয়াত-২২)। মৃত্যুর পরে এইভাবে পুনঃজীবিত করে (তাৎক্ষণিকভাবে অর্থাৎ মৃত্যুর পর পরই) প্রভুর কাছে প্রত্যানীত হবে (আনাম, আয়াত-৩৬, ৬২) (সেজদা, আয়াত-১১)। তখন তার পূর্বকর্ম পরীক্ষা করা হবে (সূরা-ইউনুস, আয়াত-৩০)। কর্মে কাহারা শ্রেষ্ঠ তা পরীক্ষা করা হয়। (সূরা-হুদ, আয়াত- ৭)। পূর্ব ইমান পরীক্ষা করা হয়। (সূরা-আনকাবুত, আয়াত-২)। অতঃপর তার কর্মফল অনুসারে প্রতিদান প্রদান করা হবে (সূরা-হুদ, আয়াত-১১১)। এই লক্ষে তাকে পুনরায় তাকে সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হবে, প্রথমবার যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল সেইভাবে। (সূরা-আরাফ, আয়াত-২৯) এই আয়াতে বাদা-য়া শব্দের অর্থ প্রকাশ পাওয়া বা ভ্রমণে বের হওয়া। (আরবী অভিধান পৃ. নং ৬৬৯) বাদা-য়া শব্দের অর্থ মরুভূমিতে অবস্থান করা। (আরবী অভিধান পৃ. নং ৬৬৮) আর কামা অর্থ এইভাবে আর আওয়াদাত শব্দের অর্থ দ্বিতীয় বার আসতে পারা। (আরবী অভিধান পৃ. নং ১৮১৩) গধশরহম ফবাড়ঃরড়হ ংরহপবৎব ংঁপয ধং ঐব পৎবধঃবফ ুড়ঁ রহ ঃযব নবমরহহরহম ংড় ংযধষষ ুড়ঁ ৎবঃঁৎহ" [ঞৎধহংষধঃব ঃড় ঊহমষরংয ঞযব ঐড়ষষু ছঁৎধহ নু আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী (ভারত) এই আয়াতের বাংলা অনুবাদটি মা'আরেফুল কোরআন এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন আল কুরআনুল কারীম, বঙ্গানুবাদ থেকে সমন্বয় করে নেয়া হয়েছে।] অর্থাৎ প্রথমবার সৃষ্টি হয়েছিল মৃত্তিকা হতে, পরে শুক্রবিন্দু হতে, তারপর আলাক হতে, তার পর মাতৃগর্ভ থেকে বাহির করা হয় শিশুরূপে। (সূরা-৪০ আয়াত-৬৭)। (সূরা-হজ, আয়াত-৫)। (সূরা-ফাতির, আয়াত-১১)। অর্থাৎ পুনরায় সৃষ্টিটা হবে মাতৃগর্ভে জন্মলাভ করার মাধ্যমে। এইভাবে তাকে পুনরায় সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হবে। এইভাবে যতবার সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হবে একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থাৎ পুনরায় সৃষ্টি করা হবে প্রথমবার যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। এভাবে চক্রাকারে জীবন-মৃত্যু পুনঃজীবিত ও পুনঃ সৃষ্টির মাধ্যমে বার বার পুনরাবর্তন ঘটানো হবে। এভাবে চক্রাকারে, জীবন-মৃত্যু-কবর-পুনঃজীবিত-প্রভুর কাছে প্রত্যানয়ন-ইমান ও কর্মপরীক্ষা-কর্মফল অনুসারে পারিশ্রমিক প্রদান-পুনঃসৃষ্টির মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা-আবার জীবন-মৃত্যু-কবর-পুনঃজীবিত-প্রভুর কাছে প্রত্যানয়ন-ইমান ও কর্মপরীক্ষা-কর্মফল অনুসারে পারিশ্রমিক প্রদান-পুনঃসৃষ্টির মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা। এখানে উল্লেখ্য যে, এই জীবনচক্র আবর্তনের ফলে দেখা যাচ্ছে (মৃত্যু+মৃত্যু) দুইবার মৃত্যু, আবার (পুনঃজীবিত + পুনঃসৃষ্টি) দুই বার জীবন (প্রভুর কাছে প্রত্যানয়ন + পারিশ্রমিক প্রদান) দুই বার পারিশ্রমিক প্রদান। এমনই ভাবে এই জীবনচক্রে একটা গাণিতিক সূত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, তোমাদেরকে মৃত্যু থেকে জীবন্ত করিয়াছেন। আবার তোমাদেরকে মৃত্যু ঘটাবেন ও পুনরায় জীবন্ত করিবেন অতঃপর প্রভুর দিকে তোমাদিগকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হবে। (সূরা বাকারা : ২৮) এখানে উল্লেখ্য যে, এ আয়াতে মৃত্যু শব্দ দুই বার এসেছে। (আমওয়াতান ও ছুম্মা উমিতুকুম) তোমাদেরকে দুইবার পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে (সূরা-২৮, আয়াত-৫৪)। (সূরা-আহযাব, আয়াত-৩১)। দুইবার মৃত্যু ও দুইবার জীবন দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। (সূরা-৪০, আয়াত-১১)। দুইবার শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং পরে মহাশাস্তির ব্যবস্থা আছে। (তওবা, আয়াত ১০১)। তবে চক্রাকারে জন্ম মৃত্যুর ঘটনায় কমপক্ষে দুইবার পারিশ্রমিক প্রদানের কথাটা উল্লেখ আসছে। তবে সার্বিক ক্ষেত্রে দুইবার কথাটাকে একাধিকবার অর্থে ব্যবহৃত হবে। কারণ, দুইবার কথার মধ্যে একাধিকবার কথাটা এসে যায়। তাই আল্লাহর সৃষ্টি জগতকে এইভাবে একাধিকবার সৃষ্টি ও মৃত্যুর মাধ্যমে একাধিকবার পারিশ্রমিক প্রদানের মাধ্যমে সৃষ্টিতে পুনরাবর্তন ঘটান। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "আল্লাহ ন্যায় বিচারের মাধ্যমে কর্মফল প্রদানের লক্ষ্যে পুনঃসৃষ্টির দ্বারা পুনরাবর্তন ঘটান।" (সূরা-ইউনুস, আয়াত-৪)। বরং তিনি তার পুনরাবৃত্তি ঘটান (সূরা-২৭, আয়াত-৬৪)। তিনি অস্তিত্ব দান করেন ও পুনরাবর্তন ঘটান (সূরা-৮৫, আয়াত-১৩)। এখানে উল্লেখ্য যে, পুনঃজীবিত বা পুনঃ সৃষ্টির বিষয়টি জীবন মৃত্যুর চক্রের প্রক্রিয়ার একটি অংশ। পক্ষান্তরে পুনরাবৃত্তি কথাটি দিয়ে জীবন মৃত্যুর ক্ষেত্রে সব কয়টি স্তরই পর্যায়ক্রমে ঘটানোকে বুঝায়। অর্থাৎ শুক্র বিন্দু থেকে আলাক, তার পর মাতৃগর্ভ থেকে শিশরূপে বাহির করা, পরে দুনিয়াতে জীবনযাপন করা, তারপর মৃত্যু, তারপর কবরস্থ, তারপর পুনঃর্জীবিত, তারপর প্রভুরকাছে প্রত্যানীত হওয়া, তারপর ইমান ও সৎকর্ম পরীক্ষা করা, তারপর কর্মফল অনুসারে পারিশ্রমিক প্রদানের লক্ষ্যে পুনঃ সৃষ্টির মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা। এইভাবে পুরো প্রক্রিয়াটিরই পুনরাবৃত্তি ঘটানো হবে। তাই (সূরা-ইউনুস, আয়াত-৪)। (সূরা-২৭, আয়াত-৬৪)। (সূরা-৮৫, আয়াত-১৩) এই সকল আয়াতে ইয়াদু শব্দ এসেছে, ইয়াদু শব্দের অর্থ পুনরাবৃত্তি বা পুনরাবর্তন ঘটানো। আরবি অভিধান পৃ.১৮১৯। এই সকল আয়াতে জীবন চক্রের প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরেই বার বার ঘটানো কথা বলা হয়েছে, ফলে এই সকল আয়াত দিয়ে পুনঃজীবিত করা হবে কিংবা পুনঃসৃষ্টি করা হবে এটা বুঝানো হয় নি, বরং জীবন মৃত্যু কবর পুরো সৃষ্টি চক্রে অর্থাৎ জীবনচক্রের পুরো প্রক্রিয়াকে বার বার ঘটানো হবে এমনটি বুঝানো হয়েছে। এইভাবে তাদের কৃতকর্মের ফল প্রদান করা হয়। (সূরা-হুদ, আয়াত- ১১১)। কারণ প্রভু কাহারো উপরে জুলুম করেন না (সূরা-১৮, আয়াত-৪৯)। রবং তারা নিজেদের উপর নিজেরাই যুলুম করেছিল, (সূরা-হুদ, আয়াত-১০১)। আল্লাহ কাহারো উপর কোনো জুলুম করে নি, বরং তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। (সূরা-নহল, আয়াত-৩৩)। তাদের কর্মের ফল প্রদানের জন্য "তাদেরকে নতুন ভাবে সৃষ্টি করা হবে।" (সূরা-৩৪, আয়াত-৭)। সেইক্ষণে তাদের "কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করা হবে।" (সূরা-৬৪, আয়াত-৭)। তখন তারা অধোবদন হয়ে প্রভুর কাছে বলবে, "আমরা সব শুনলাম ও দেখলাম আমাদেরকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দাও, যাতে আমরা সৎ কর্ম করতে পারি" (সেজদা, আয়াত-১২)। তখন আল্লাহ বলবেন, "তোমরা তো এই কথাটা মৃত্যুর সময়ও বলেছিলে" (সূরা-২৩, আয়াত-৯৯)। কিন্তু না, ইহা হইবার নয়। ইহা একটা উক্তি মাত্র। (সূরা-২৩, আয়াত-১০০)। বরং তোমাদের পূর্ব জীবন এবং পরবর্তী সৃষ্ট নতুন জীবন এর মাঝখানে থাকবে এক অবেধ্য অন্তরাল, যাতে তোমরা আর কখনও পূর্ব জীবনের কোনো কিছু স্মৃতিতে আনয়ন করতে পারবে না। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "তাদের সম্মুখে থাকবে বারযখ বা অন্তরাল।" (সূরা-২৩, আয়াত-১০০)। এই বরযখের মাধ্যমে তাদেরকে শৃংখলিত রাখা হবে। (সূরা-১৩, আয়াত-৫)। তবে এই শৃংখল বা বরযখ থাকবে আবার মৃত্যুর পরে পুনঃজীবিত হওয়ার দিন পর্যন্ত। (সূরা-২৩, আয়াত-১০০)। কাজেই পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। বরং তোমরা থাকবে অন্তরালে পরবর্তী পুনঃজীবিত না হওয়া পর্যন্ত। এই আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, শেষ বিচারের পূর্বে প্রভুর নিকট উপস্থিতির মাধ্যমে বিচার কার্য করতঃ ইমান ও সৎ কর্মের পরীক্ষা করতঃ পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে। এইভাবে আবার তার কৃতকর্মের বিচার কার্য হবে, পুনরায় তাকে আবার কর্মের ফলাফল হিসেবে সৃষ্টি করা হবে তখন সে কোনো আকৃতি প্রাপ্ত হবে, এটা নির্ভর করছে তার কর্মের ফলাফলের উপর। অর্থাৎ কেউ যদি মানুষ হয়ে পশুর মত কর্ম করে তাহলে তাকে মানুষের স্তর থেকে পশুর স্তরে অর্থাৎ নিম্ন স্তরে নামিয়ে দেওয়া হবে। তখন সে আর মানব আকৃতি পাবে না। তাকে সৃষ্টি করা হবে পশু আকৃতিতে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "তোমাকে সুন্দর আকৃতির অনুকরণে সৃষ্টি করেছি, কিন্তু কর্মফলে আবার তোমাকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতায় পরিণত করি।" (সূরা-ত্বীন, আয়াত-৪ ও আয়াত-৫)। অর্থাৎ কর্মদোষে কেউ জীব আকৃতি প্রাপ্ত হয়। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "তোমরা ঘৃণিত বানর হও।" (সূরা-বাকারা, আয়াত-৬৫)। অর্থাৎ যারা নিষিদ্ধ কার্য করবে, তাদেরকে ঘৃণিত বানর করে সৃষ্টি করা হবে। (সূরা-আরাফ, আয়াত-১৬৬)। এমনই ভাবে তারা যে মানব রূপে ছিল, তারা হয়ত কর্মদোষে কেউবা পশু হবে আবার কেউবা তাদের স্থলে তাদের সাদৃশ্য মানব হবে অন্য আকৃতিতে। যা তাদের অজানা। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "তাদের স্থলে তাদের সাদৃশ্য আনয়ন করা হবে এবং তাদেরকে এমন আকৃতি দান করা হবে যা তাদের জানা নেই।" (সূরা-ওয়াকিয়া, আয়াত-৬১)। তারা শুধু জানবে প্রথমে তার যে আকৃতি ছিল। (সূরা-ওয়াকিয়া, আয়াত-৬২)। এই ভাবে জীবনচক্রের মাধ্যমে শেষ বিচারের কঠিন শাস্তির পূর্বে লঘু শাস্তির মাধ্যমে সংশোধন করার সুযোগ দিয়ে থাকে। (সেজদা, আয়াত-২১)। এইভাবে ধাপে ধাপে তাকে উন্নতির দিকে আহরণ করে। (সূরা-৮৪, আয়াত-১৯)। যাতে মানুষ ইমান ও সৎ কর্ম অর্জনের মাধ্যমে অপরাধ থেকে ফিরে আসতে পারে। এইভাবে প্রত্যেক জীবের মৃত্যু হবে এবং প্রত্যেক জীবই প্রভুর কাছে প্রত্যানীত হবে। (সূরা-আনকাবুত, আয়াত-৫৭)। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "আমি প্রত্যেক জীবকে মৃত্যু ঘটাই এবং ভাল মন্দ বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই নিকট পুনরায় প্রত্যানীত করি।" (সূরা-আম্বিয়া, আয়াত-৩৫)। এইভাবে মানুষের সৃষ্টি ও পুনঃজীবিতকরণ প্রক্রিয়া ও একটি জীবজন্তুর সৃষ্টি ও পুনঃজীবিতকরণ প্রক্রিয়া একই রকম। (সূরা-৩১, আয়াত-২৮)। আত্মীকরণের ক্ষেত্রে পশু এবং মানব আত্মার কোনো ভেদাভেদ নেই কারণ পশু আত্মা ও মানব আত্মার মধ্যে ভিন্নতা আছে মর্মে কোনো আয়াত পবিত্র কোরআনে আসে নি, কাজেই সকল জীবই এক আত্মা তথা সকল জীবেরই মৃত্যু হবে (সূরা-আনকাবুত, আয়াত-৫৭) এবং সকল জীবেই প্রভুসত্তা রুহুরূপে বিরাজমান। (সূরা-বনি ইসরাইল, আয়াত-৮৫)। তাই এক জীব থেকে অন্য জীবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে কখনও-বা মানুষ কখনও-বা পশু কখনও অপূর্ণাঙ্গ মানুষÑ এই কবি নজরুল বলেছে 'মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম' তিনি আরও বলেছেনÑ 'কেমন করে ঘুরছে মানুষ, যুগান্তরে ঘুরণি পাকে'।
এমনই ভাবে জীবজগৎ পর্যায়ক্রমে আবর্তনের মাধ্যমে "সৃষ্টিতে এনে পুনরাবর্তন ঘটানো হচ্ছে।" (সূরা-ইউনুস, আয়াত-৪)। (সূরা-২৭, আয়াত-৬৪)। (সূরা-৮৫, আয়াত-১৩)। কারণ এজন্য পৃথিবীর কোনো কিছু আল্লাহ নিরর্থক সৃষ্টি করেন নি। (নং-১৪, আয়াত-৮৬)। তাই কর্ম অনুসারে শাস্তি বিধান রাখা হয়েছে। বিধায় কেউবা জন্মসূত্রে অন্ধ, কেউবা বোবা, কেউবা লেংড়া, কেউবা পঙ্গু, কেউবা রোগাগ্রস্ত, কেউবা হতদরিদ্র, কেউবা অভিশপ্ত। এই গুলি সবই তার পূর্ব কর্মের ফল সে এই জন্মে ভোগ করছে। এটাই তার পূর্ব কর্মের জন্য শাস্তি বা আজাব বা অগ্নি। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, পৃথিবীতে তোমাদের উপর যে বিপর্যয় আসে পূর্বেই উহা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। (সূর হাদীদ : ২২) কারণ আল্লাহ কারো প্রতি যুলুম করেনা। (সূরা-১৮, আয়াত-৪৯)। আর তাই তারা পূর্ব জন্মের নিজ কর্মদোষেই তারা শাস্তি প্রাপ্য। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, পৃথিবীতে যত বিপদ আপদ ঘটে তা তার কর্মের কারণেই ঘটে। (সূরা-৪২ শুরা, আয়াত-৩০)। মানুষের যত অকল্যাণ হয় তা তার নিজ কর্মের কারণেই হয়। (সূরা নেসা : ৭৯) এই সকল বিপদ আপদ ও শাস্তি তার জন্য জাহিম বা অগ্নিস্বরূপ। যা তার জন্য শৃঙ্খলস্বরূপ নির্দিষ্ট যা তার মৃত্যু পর্যন্ত, অর্থাৎ মৃত্যুর পরে পুনঃজীবিত হওয়া পর্যন্ত। এটাই আলমে বরযখ বলা হয়েছে। (সূরা-২৩, আয়াত-১০০)। এইভাবে জীবকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, এই দর্শনে যারা বিশ্বাসী তারা অবশ্যই জাহিম বা অগ্নির শাস্তি দেখতে পাবে। (সূরা-১০২, আয়াত-৬)। এই দেহের মাধ্যমে তাকে শৃঙ্খলিত করে কোনো এক সংকীর্ণ স্থানে তাকে নিক্ষেপ করা হবে। (সূরা-ফুরকান, আয়াত-১৩)। অপরাধীরা থাকিবে শৃঙ্খলিত অবস্থায় (সূরা-১৪, আয়াত-৪৯)। (সূরা-১৩, আয়াত-৫)। এই ভাবে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে মর্মে আল্লাহ বলেন, "তোমাদের হিসাব নিকাশের দিন আসন্ন।" (সূরা-আম্বিয়া, আয়াত-১)। জীব দেহ থেকে জীবকে সৃষ্টি করা হয়েছে, আবার তাকে মৃত্যুর পরে জীব দেহের মধ্য দিয়েই সৃষ্টিতে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, আবার তাকে জীবদেহের মাধ্যমেই উঠানো হচ্ছে, এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "তিনি তোমাকে মৃত্তিকা হতে (তথা জীবদেহ হতে) উদ্ভুত করেন।" (সূরা-৭১, আয়াত-১৭)। আবার তিনি তাতেই তোমাদেরকে প্রত্যানয়ন করবেন, অর্থাৎ জীবদেহের মাধ্যমে পুনরাবর্তন ঘটান। আবার উহা (অর্থাৎ জীবদেহ থেকেই সন্তান হিসেবে) বের করবেন। (সূরা-৭১, আয়াত-১৮)। এভাবে জন্ম থেকে জন্মান্তরে ইমান ও কর্মফল মুহূর্ত অনুসারে জীবন চক্র ঘটান। শেষ বিচারের দিন আগত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। অর্থাৎ যখন প্রথমবার শিংগায় ফুৎকার দিবেন, আসমান ও যমিনের যা কিছু আছে সকলে মূর্ছা যাবে অর্থাৎ মৃত্যু হবে (সূরা-৩৯, আয়াত-৬৮) তখন সকল কিছু ধ্বংস হবে (সূরা-৬৯, আয়াত-১৪)। সকল কিছু ধ্বংস হবে একমাত্র প্রভু স্বত্তা ব্যতীত (সূরা-কাছাস, আয়াত-৮৮)। অর্থাৎ সকলের মৃত্যু হবে এবং মৃত্যুর পরই সকলেই কবরস্থ হবে (সূরা-৮০, আয়াত-২১)। দ্বিতীয়বার শিংগায় ফুৎকার দিলে সকলেই উঠে দাঁড়াবে (জুমার, আয়াত-৬৮)। দ্বিতীয়বার শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে তখন দেহে আত্মার সংযোজন করা হবে (তাকবীর, আয়াত-৭)। তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। (আবাসা, আয়াত-২২)। কবর উন্মোচিত করা হবে। (ইনফিতর, আয়াত-৪)। কবর থেকে উত্থিত হবে। (আদিয়াত, আয়াত-৯)। কবর থেকে বের হবে দ্রুত বেগে। (মাআরিজ, আয়াত-৪৩)। কবর থেকে বের হবে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের ন্যায়। (কামার, আয়াত-৭)। তখন কবর থেকে উঠে প্রভুর দিকে ছুটতে থাকবে। (সূরা-হজ, আয়াত-৭)। (সূরা-৩৬, আয়াত-৫১)। এখানে কবর বলতে প্রথম শিংগায় ফুৎকার দেওয়ার পর থেকে দ্বিতীয় শিংগায় ফুৎকার দেওয়া পর্যন্ত এই নির্জীব অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। কারণ প্রথম শিংগায় ফুৎকার দিলে সকলের মৃত্যু হচ্ছে। আবার দ্বিতীয় শিংগায় ফুৎকার দিলে সকলে দ-ায়মান হচ্ছে (সুরা যুমার-৬৮)।
শেষ বিচারের মাধ্যমে কাউকে জান্নাত অথবা কাউকে জাহান্নাম দেয়া হবে। সেখানে তারা স্থায়ী হবে যতদিন পৃথিবী স্থায়ী থাকবে। কিংবা যতদিন প্রভু অন্যরূপ ইচ্ছা না করবে। (সূরা-হুদ, আয়াত-১০৬) এবং (সূরা-হুদ, আয়াত-১০৭)।
এটা কোরআনের দর্শন, কোরআনই দ্বীনের ক্ষেত্রে একমাত্র দলিল। মানব জাতীর জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দলিল ও নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য পথ নির্দেশ। (৪৫ সূরা-জাছিয়া, আয়াত-২০)। (সূরা-রাদ, আয়াত-৩৭)। আল্লাহর এই নিয়মের কোনো পরিবর্তন নেই (সূরার-রুম, আয়াত-৩০) এবং (সূরা-বণি ইসরাইল, আয়াত-৭৭)। পবিত্র কোরআনা দর্শনে জীবন বিধান প্রণয়ন করা আমাদের সকলের কর্তব্য।
বাদ্যযন্ত্র হারাম এ কথা কোরআনে উল্লেখ নেই
তোমরা আল্লাহকে এমনভাবে স্মরণ করবে, যেমন তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষগণকে স্মরণ করতে। (বাকারা, আয়াত-২০০)। অন্ধকার যুগে হজ সমাপনান্তে মিনার ময়দানে একত্রিত হয়ে কবিতা, লোক-গাঁথা ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের শৌর্য-বীর্য বর্ণনার প্রথা ছিল। (টীকা নং-১৪৭), (ইসলামি ফাউন্ডেশন, আল কুরআনুল কারিমের বঙ্গানুবাদ থেকে)। এখানে কবিতা শব্দ এসেছে আর কবিতার আরবি শব্দ হচ্ছে উনসুদাতু। আর উনসুদাতু শব্দের অর্থ হচ্ছে কবিতা, গান বা সংগীত। (আরবি অভিধান পৃ.-৫৬৪) অর্থাৎ পিতৃপুরুষগণের বিরহ বিচ্ছেদ তাদের অন্তরে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। লোকগাঁথা, ছন্দযুক্ত কথামালা, কবিতা তথা সংগীত এর মাধ্যমে সুরের লহরীতে সেই সুপ্ত বেদনা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে বেদনার সাগরে উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি করে আর তারা সেই তরঙ্গেই সন্তরণ করার মাধ্যমে পিতৃপুরুষগণের স্মরণে এক মাতম সৃষ্টি করে। যেমন ভাবে ফেরেস্তারা প্রভুর প্রেম তরঙ্গে সন্তরণের মাধ্যমে প্রভুর স্তুতিগান বা গুণকীর্তন করে থাকেন। (সূরা-বাকারা, আয়াত- ৩০)। (সূরা দাহর : ২৬) এই আয়াতে সাব্বিহু শব্দ এসেছে। সাব্বিহু শব্দের অর্থ সন্তরণ করা। (আরবি অভিধান পৃ. ১৪২৬)। অর্থাৎ ফেরেস্তারা প্রভুর প্রেম তরঙ্গে সন্তরণের মাধ্যমে প্রভুর স্তুতিগান বা গুণকীর্তন করে থাকে। অনেকেই বলেন উপরিউক্ত আয়াতদ্বয় অনুসারে স্তুতিগান বা লোকগাঁথা বা সংগীতের মাধ্যমে প্রভুর স্মরণ করা যাবে। তবে সে ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, শুধু লোক-গাঁথা, ছন্দযুক্ত কথামালা বা সংগীতের দ্বারা প্রভুর প্রেম তরঙ্গে সন্তরণের মাধ্যমে স্তুতিগান ও গুণ-কীর্তন করলে অন্তরে যে ভাবের উদয় হয়, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে তদপেক্ষা অভিনিবেশ সহকারে প্রভুর স্মরণের এক উচ্চমার্গে পৌঁছাতে সম্ভব হয়। ফলে তাদের ইমানের সাথে আরো ইমান বেড়ে যায় এভাবে যে, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে প্রভুর এস্কের সাথে আরো এস্ক বৃদ্ধি পায়। এভাবে তিনি মমিনদের অন্তরে প্রশান্তি দান করেন, যাতে তাদের ইমানের সাথে আরো ইমান বেড়ে যায়। (সূরা-ফাতহ, আয়াত-৪) তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে এস্কের সাথে এস্ক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ইমানের সাথে আরো ইমান বেড়ে যাচ্ছে ফলে তাদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল হয়, বিধায় তারা পূর্বের অপেক্ষা অর্থাৎ তদপেক্ষা অভিনিবেশসহকারে প্রভুর নাম স্মরণে একনিষ্ঠভাবে নিমগ্ন হতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে প্রভুর স্মরণে একনিষ্ঠভাবে তাতে নিমগ্ন হওয়া সম্ভব। আল্লাহ বলেন, তুমি তোমার প্রভুর নাম স্মরণ কর এবং একনিষ্ঠভাবে তাতে নিমগ্ন হও। (সূরা-মুজাম্মেল, আয়াত-৮)। প্রচলিত প্রক্রিয়ায় ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে প্রভুর নাম স্মরণে একনিষ্ঠভাবে নিমগ্ন হওয়া সম্ভব নয়। অথচ বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে প্রভুর প্রেমতরঙ্গে সন্তরণের মাধ্যমে যদি কেউ স্তুতিগান করে তাহলে সে প্রভুর নাম স্মরণে একনিষ্ঠভাবে নিমগ্ন হতে পারবে। উপরিউক্ত আয়াত অনুসারে যেহেতু প্রভুর নাম স্মরণে একনিষ্ঠভাবে নিমগ্ন হওয়া জরুরি আর বাদ্যযন্ত্র ছাড়া তা সম্ভব নয় বিধায় উপরিউক্ত আয়াত অনুসারে বাদ্যন্ত্রের ব্যবহার জরুরি। যে সকল সাধকগণের অন্তরে প্রভুর এস্কের অগ্নিময় জ্বালা সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করে তারা যখন বাদ্যযন্ত্রের দ্বারা সুরের লহরী তুলে প্রেম সাগরে সন্তরণের মাধ্যমে প্রভুর প্রেমের স্তুতিগানে নিয়োজিত হয় তখন এই সুপ্ত জ্বালাময় অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে অন্তরের সকল প্রকার আবিল্যকে দগ্ধিভূত করে প্রভুর এস্ক বহুগুণে বৃদ্ধি করে সাধককে এমন এক প্রেমময় অনাবিল শান্তির স্তরে পৌছে দেয় যা অন্য কোনো রেয়াযতের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এই বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশিষ্ট সাধক আল-ইমাম গাজ্জালী (র.) তাঁর প্রসিদ্ধ কিমিয়ায়ে সাদ্আত গ্রন্থের ২য় খ-ের সামা অধ্যায়ের ১৮০ পৃষ্ঠায় বিষদভাবে বর্ণনা করেছেন। এই স্তরে এসে সাধক প্রভুর প্রেমের যে স্বাদ বা অনুভূতি লাভ করে তা সাধারণত লিখে বা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। একমাত্র ভুক্তভোগী অভিজ্ঞ সাধক ছাড়া কেউ অনুভব করতে সক্ষম হবে না। এই মর্মে মওলানা রুমী (র.) তাঁর মসনবী শরিফে লিখেছেনÑ "ঝুলন্ত লতায় বসে মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া যে কি শান্তি, তা ছোট্ট বুলবুলি পাখি ছাড়া ঐ বাজপাখি কখনো তা বুঝতে পারে না।" কারণ বাজপাখি যেহেতু আকারে বড়, সেহেতু সে ঝুলন্ত লতায় বসতেই পারে না। আর তাই বাজপাখি তা কখনো বুঝতে পারেনা বিধায় বাজপাখিকে তা কখনো বুঝানো সম্ভব নয়। বিষয়টি এমন যে, একজন নপুংশ ব্যক্তিকে কখনোও কামতৃপ্তি সম্পর্কে ধারণা দেয়া সম্ভব না। তদ্রƒপ যাদের অন্তরে প্রভুর দর্শন নেই, প্রভুর এস্ক নেই, প্রভুর বিচ্ছেদের যন্ত্রণা নেই, তাদেরকে বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে স্তুতিগানের মাধ্যমে সৃষ্ট আবেগময় অনুভূতিকে বুঝানো সম্ভব নয়। এটা একটা বাস্তবমুখী অধ্যায়। যা সাধক তার সাধনার কোনো এক স্তরে পৌঁছে অনুভব করে থাকে। এই মর্মে পাক-ভারত উপ-মহাদেশের শ্রেষ্ঠ সাধক হিন্দেল অলী আতায়ে রসূল গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্ত (আজমীরি) (র.)-এর সামার মাহফিলে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
অনেকেই বলে প্রভুর স্মরণে নিমগ্ন হতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হারাম। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, বাদ্যযন্ত্র হারাম মর্মে কোনো আয়াত পবিত্র কোরআনে আসে নি। এখানে উল্লেখ্য যে, যন্ত্রের আরবি শব্দ হচ্ছে 'আলাতুন' (আরবি অভিধান, পৃষ্ঠা-৪৬৬)। আর বাদ্যযন্ত্রের আরবি শব্দ হচ্ছে 'আলাতুন মুশকিয়াতুন' (আরবি-বাংলা- ইংরেজি অভিধান, পৃ. ৫০৬)। স্বয়ং আল্লাহ বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করে নি, তারপরও যদি কেউ বাদ্যযন্ত্রকে হারাম জেনে থাকেন তাহলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার সামিল হয়। কারণ দ্বীনের বিষয়ে এই কোরআনই স্পষ্ট দলিল। (সূরা-জাছিয়া, আয়াত-২০)। (সূরা-রাদ, আয়াত-৩৭ )। পবিত্র কোরআনই দ্বীনের বিষয়ে পরিপূর্ণ। (সূরা-মায়েদা, আয়াত-৩)। আর আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী সবচেয়ে বড় জালিম। (সূরা-হুদ, আয়াত-১৮)। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেকেই বলে থাকেন যে, বাদ্যযন্ত্র হারাম কথাটা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ নেই, কিন্তু বাদ্যযন্ত্র যে হালাল সেটা কোনো আয়াতে উল্লেখ আছে? সে প্রসঙ্গে বলছি, আল্লাহর সকল হালাল সৃষ্টির নাম কোরআনে উল্লেখ করতে গেলে কোরআনের কলেবর বৃদ্ধি পায় কারণ হালাল বস্তুর সংখ্যা অধিক। পক্ষান্তরে হারাম বস্তুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম বিধায় আল্লাহ এই মর্মে বলেন, আমি যা হারাম করেছি তা ব্যতীত যাবতীয় বিষয়ই হালাল। (ইমরান, আয়াত-৯৩)। যেহেতু বাদ্যযন্ত্র হারাম মর্মে পবিত্র কোরআনে কোনো আয়াত নেই বিধায় এই আয়াত অনুসারে বাদ্যযন্ত্র হালাল এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর হালাল বস্তুকে হারাম জানিও না। (মায়েদা, আয়াত-৮৭)। আমাদের মূল আলোচনা হচ্ছে সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রযোজ্য কি না? এই মর্মে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ইবলিস মানুষের মধ্যে নফসানী প্রবণতাকে বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রভুর এস্কের বিপরীতে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করে মানুষকে দুনিয়াবী মোহে মত্ত রাখে, তাই বর্তমান সমাজের মানুষ এই বাদ্যযন্ত্রের অপব্যবহার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বিধায় প্রভুর এস্কের দিকে মানুষকে ফিরিয়ে আনতে আমাদেরকেও ইসলামি সাংস্কৃতি তথা ইসলামি সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বা প্রয়োগ ঘটাতে হবে। অর্থাৎ ইসলামি সংগীত বা সামার মাধ্যমে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ঘটিয়ে মানুষকে প্রভুর এস্কের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, তোমরা যেভাবে আক্রান্ত হও, সেভাবেই তা প্রতিহত কর। (বাকারা, আয়াত-১৯৪)। তা ছাড়াও যুদ্ধক্ষেত্রে কাফেরদের বিপক্ষে মমিনদেরকে একনিষ্ঠ করে সুশৃৃঙ্খলভাবে আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছিল। বাদ্যযন্ত্র হারাম বা অপবিত্র হলে মহানবী (স.) যুদ্ধক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ প্রেমিক তথা আধ্যাত্মিক সাধকদের ইসলামি সংগীত তথা সামা পাঠের মজলিশে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার অধিক ফলপ্রসূ। এই পর্যায়ে এসে কিছু লোক এমনও বলে থাকেন যে, শুধু আল্লাহর প্রেমিক সাধক পুরুষগণ ব্যতীত দুনিয়াবী মোহে মত্ত সাধারণ কোনো ব্যক্তি সাধকদের ঐ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারযুক্ত ছামার মাহফিলে উপস্থিত থাকতে পারবে না। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, একটি ফুল বাগানে শুধু ফুল দিতে সক্ষম এমন গাছ রেখে বাকি সকল চারা গাছ যদি কর্তন করা হয়, তাহলে একসময় বাগানটি ফুলশূন্য হয়ে যাবে। কারণ ফুল দিতে সক্ষম গাছগুলো একসময় ফুল দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। তাই আজকের চারা গাছটা বাগানে স্বযতেœ রাখতে হবে এজন্য যে, একসময় এরাও ফুল দিবে, তদ্রƒপ সাধকের সামার মাহফিলে সাধারণ মানুষও উপস্থিত থাকবে, কারণ একসময় এরাও আল্লাহর প্রেমিক সাধকদের সংস্পর্শে এসে প্রভুর প্রেমিক হবে। তাই সর্বসাধারণের জন্য ইসলামি সংগীত অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার জায়েয এতে কোনো সন্দেহ নেই।

জয় গুরু কেন বলি


আল্লাহর গুণবাচক নাম গুরু। (রহমান, ৪ আয়াত) কীভাবে গুরু নামটি আল্লাহর একত্ববাদের নাম হল? তবে তার আগে জানতে হবে একত্ববাদের দ্বীন কী? আল্লাহর একত্ববাদে আত্মসমর্পণ করাই হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত দ্বীন। (ইমরান, ৮৫ আয়াত)। অর্থাৎ দ্বীনের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে একে একত্ববাদ আর একের অধিক শেরেকবাদ। দ্বীনের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে কোনো অবস্থায়ই শরিক বা ভাগাভাগি করা যাবে না। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, দ্বীনের ব্যাপারে সকল কিছুই একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য। (যুমার, ৩ আয়াত)। তবে দ্বীনের ব্যাপারে যদি কেউ রসূলকে বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহকেই ডাকে তাহলে সে ইবলিসের অনুসারী কাফের হবে। কারণ ইবলিসও রসূলকে বাদ দিয়ে শুধু আল্লাহকেই ডাকে। অনেকের ধারণা ইবলিস হয়ত আল্লাহকে প্রভু বলে না। কিন্তু না। লান্নত ঘোষণার পরও ইবলিস আল্লাহকে প্রভু বলে। (হিযর, ৩৬ আয়াত)। তাই যারা দ্বীনের ব্যাপারে রসূলকে বাদ দিয়ে শুধু আল্লাহকেই ডাকে সে ইবলিসের অনুসারী কাফের হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে রসূলকে কোনো অবস্থাতেই দ্বীনের ব্যাপারে বাদ দেওয়া যাবে না। আবার রসূলকে নিতে গেলে দ্বীনের দৃষ্টিভঙ্গি দুই দিকে চলে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে রসূলের নাম জপনা এসে যাচ্ছে, ফলে শেরেকবাদ গণ্য হচ্ছে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে ডেক না। (জিন, ১৮ আয়াত)। কাজেই দেখা যাচ্ছে রসূলকে বাদ দিলেও কাফের আবার আল্লার সাথে রসূলকে ডাকলেও শেরেক। আবার যদি কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে দ্বীনের ব্যাপারে শুধু রসূলকেই ডাকে তাহলে সে কাফের হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কাউকে ডেকো না (ইউনুস, ১০৬ আয়াত)। তাহলে সমস্যাটা এমন যে, আল্লাহকে বাদ দিলেও কাফের, আবার রসূলকে বাদ দিলেও কাফের। আবার আল্লাহর সাথে রসূলকে ডাকলেও শেরেক এই শেরেক এড়ানোর জন্য আল্লাহ ও রসূলের গুণবাচক নামের মধ্য হতে এমন একটি কমন নাম নিতে হবে যে নামে আল্লাহ ও রসূলকে একাকার ও অবিচ্ছিন্নভাবে ডাকা যায়। আমরা জানি রসূলের গুণবাচক নাম গুরু।(বাকারা, ১৫১ আয়াত)। (ইমরান, ১৬৪ আয়াত)। আল্লাহর গুণবাচক নাম গুরু (রহমান, ৪ আয়াত)। এই গুরু নামই আল্লাহ ও রসূলের কমন গুনবাচক নাম। তাই এই গুরু নাম নিলেই আল্লাহ ও রসূলকে একাকার ও অবিচ্ছিন্নভাবে ডাকা হয়ে যায় আবার শেরেকও হয় না। তাই দ্বীনের ব্যাপারে এই গুরু নামই হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদের নাম। তাই মোমেনগণ গুরু নামে আল্লাহ ও রসূলকে একাকার ও অবিচ্ছিন্নভাবে ডাকে। এই মমিনদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, "যারা আল্লাহ ও রসূলে বিশ্বাস করে এবং তাদের মধ্যে ফারাক বা পৃথক করে না অর্থাৎ ংবঢ়ধৎবঃব করে না তাদের জন্য মহা পুরস্কার" (নেছা, ১৫২ আয়াত)। রসুলের সাথেই আল্লাহ আছেন (সুরা হাদিদ-৪)। অর্থাৎ রসুলের হাত আল্লাহর হাত, (ফাতহ, ১০ আয়াত)। আবার রসূলের অনুসরণ করা আল্লাহকেই ভালবাসা। (ইমরান, ৩১ আয়াত)। রসুলের আনুগত্য করা আল্লাহরই আনুগত্য করা। (নেছা, ৮০ আয়াত)। আবার রসূলের মধ্যে স্বয়ং আল্লাহই সক্রিয় আছেন। (আনফাল, ১৭আয়াত)। এই সকল আয়াত অনুসারে মমিনগণ রসূল এর মধ্যে রসূলকে বিলীন করে ঐ সুরতে আল্লাহকে বর্তমান করে রসূল এবং আল্লাহকে একাকার ও অবিচ্ছিন্নভাবে বিশ্বাস করে। তাই রসূল তথা গুরু নামই আল্লাহ ও রসূলের একত্ববাদের নাম।

গুরু নাম আল্লাহর উত্তম গুণবাচক নাম

যেহেতু আল্লাহর গুণবাচক নাম গুরু (রহমান, ৪ আয়াত) আবার রসুলের গুণবাচক নাম গুরু (বাকারা-১৫১) আর এই গুরু নামই দ্বীনের ব্যাপারে আল্লাহর একটি উত্তম গুণবাচক নাম। কারণ ইবলিস গুরু নামে রসূলকে ডাকে না। গুরু নামে আল্লাহকেও ডাকে না। যদি রসূলকে গুরু নামে ডাকে তাহলে রসূলকে আল্লাহ বলার সামিল হয়ে যায়। কারণ আল্লাহর গুণবাচক নাম তো গুরু।সেক্ষেত্রে গুরু নাম নিলে আল্লাহ রসূলকে একাকার ও অবিচ্ছিন্নভাবে ডাকা হয়ে যায়। কিন্তু ইবলিস কখনও আল্লাহ রসূলকে একাকার ও অবিচ্ছিন্নভাবে ডাকবে না। যদি এমনভাবে ডাকে তাহলে রসুলের হাত আল্লাহর হাত বিশ্বাস করা হয়ে যায়। রসুলের মধ্যেই আল্লাহ পাক সক্রিয় এমনই বিশ্বাস করা হয়ে যায়। (বি: দ্র:- গুরু নাম আল্লাহর একত্ববাদের নাম এই অধ্যায়ে বিস্তারিত দেখুন)। সেক্ষেত্রে রসূল কাবাই আল্লাহকে সেজদা দেওয়া জরুরি হয়ে যায়। কারণ ইবলিস আদম কাবায় সেজদা না দিয়েই কাফের। (বাকারা, ৩৪ আয়াত)। সেহেতু ইবলিস কখনও রসূলকাবায় আল্লাহকে সেজদা দেবে না। আর তাই ইবলিস আল্লাহ ও রসূলকে একাকার ও অবিচ্ছিন্নভাবে ডাকবে না বিধায়ই ইবলিস কখনও গুরু নামে আল্লাহ ও রসূলকে ডাকে না। যে নামে ইবলিস আল্লাহ রসূলকে ডাকে না সেই নামই আল্লাহর উত্তম গুণবাচক নাম। এই জন্যই আল্লাহ বলেন তোমরা ইবলিসের অনুসরণ করোনা (বাকারা, ২০৮ আয়াত)। তাই মমিনগণ ইবলিসের অনুসরণ থেকে বিরত থাকার লক্ষ্যেই গুরু নামে আল্লাহকে ডাকে।

দুনিয়াবী ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আনুগত্য করা ফরজ

এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রসূলের আনুগত্য কর এবং উলিল আমরগণের আনুগত্য কর (নেসা, ৫৯ আয়াত)। এই আয়াতের মধ্যে দুই ধরনের আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। (১) একটি হচ্ছে দ্বীনের ক্ষেত্রে আনুগত্য করা, (২) অপরটি হচ্ছে দুনিয়াবী ক্ষেত্রে আনুগত্য করা। এখন আমাদের জানতে হবে, দ্বীনের ক্ষেত্রে আনুগত্য কাকে বলে আর দুনিয়াবী ক্ষেত্রে আনুগত্য কাকে বলে। অর্থাৎ দ্বীনের ক্ষেত্রে আনুগত্য আর দুনিয়াবী ক্ষেত্রে আনুগত্য পার্থক্য কী? যে আনুগত্য আল্লাহ পর্যন্ত পৌছে সে আনুগত্যটা দ্বীনের আনুগত্য। কারণ দ্বীনের বিষয়ে সকল কিছু আল্লাহ পাবে (জুমার, ৩ আয়াত) আর যে আনুগত্য দুনিয়াবী শৃংখলা ও শান্তি রক্ষার জন্য করা, সে আনুগত্য দুনিয়াবী আনুগত্য। যেহেতু রসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহর আনুগত্য করা হয় (নেছা, ৮০ আয়াত) সেহেতু রসূলের আনুগত্য দ্বীনের আনুগত্যে গণ্য। পক্ষান্তরে উলিল আমরগণের আনুগত্য করলে সে আনুগত্য আল্লাহর হবে কিংবা রসূলের হবে এমন কোনো আয়াত নেই বিধায় উলিল আমরগণের আনুগত্য দ্বীনের আনুগত্যে গণ্য হচ্ছে না। শুধু দুনিয়াবী শৃংখলা ও শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে উলিল আমর গণের আনুগত্য করতে বলা হয়েছে বিধায় উলিল আমরগণের আনুগত্য দুনিয়াবী আনুগত্যে গণ্য। এখন আমরা এই দুই আনুগত্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করি। সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দ্বীনের আনুগত্যে সেজদা থাকতে হবে, কারণ সকল দ্বীনের ক্ষেত্রে সকল কিছুই আল্লাহর জন্য। (জুমা, ৩ আয়াত)। এবং সকল সেজদা আল্লাহর জন্য। (সূরা-জ্বীন, ১৮ আয়াত)। আর দুনিয়াবী আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোনো সেজদা থাকবে না। কিন্তু রসূলের আনুগত্যের ভিতরে সেজদা আছে, কারণ আদম রসূল আল্লাহর খলিফা। (সূরা-বাকারা, ৩০ নংআয়াত)। আর আল্লাহর খলিফা আদম রসূল সেজদা পায়। (সূরা-হিযর, ২৯ আয়াত)। তাহলে রসূলের আনুগত্য সেজদা আছে প্রমাণিত হয়। আমরা জানি সেজদা যেখানে দ্বীন সেখানে। অতএব রসূলের আনুগত্য দ্বীনের আনুগত্যে প্রমাণিত। পক্ষান্তরে উলিল আমরগণের আনুগত্যে কোনো সেজদা নেই বিধায় এদের আনুগত্য দুনিয়াবী ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। কাজেই উলিল আমরগণ কখনো রসূল নয় কিংবা রসূলের বিকল্প নয়। কিংবা এরা নায়েবে রসূলও নয়। আবার সূরা-নেসার ৫৯ আয়াত অনুসারে অনেকেই রসুলের বিকল্প হিসেবে দ্বীনের ক্ষেত্রে উলিল আমরগণের আনুগত্য করে থাকে। এই আয়াতে এসেছে রসূলের আনুগত্য কর এবং উলিল আমরগণের আনুগত্য কর। যেহেতু এই আয়াতে রসূল এবং উলিল আমরগণের মাঝখানে 'এবং' কথা এসেছে, তাহলে দুইজনের আনুগত্য করাই ফরয। যদি দুইয়ের মাঝখানে 'অথবা' কথা আসত, তাহলে উলিল আমরগণ রসূলের বিকল্প হিসেবে প্রমাণ হতো। যেহেতু ঐ আয়াতে দুই এর মাঝখানে এবং কথা এসেছে এতে প্রমাণ হয় যে, উলিল আমরগণ রসূলের বিকল্প নয়। তারপরও নেসার ৫৯ আয়াতটি যখন নাজেল হয়েছে তখনতো নবী (সা.) জীবিত। এই আয়াত নাজিল হওয়ার পরে দ্বীনের ক্ষেত্রে নবী (সা.) এর পরও তৃতীয় ব্যক্তির আনুগত্য করা প্রয়োজন হতো। কেননা উক্ত আয়াতটি তখনকার মোমিনদের জন্য প্রয়োজন ছিল। তৎকালীন সময়ে দ্বীনের ক্ষেত্রে নবী (সা.) ভিন্ন অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তির আনুগত্য মোমিনগণ করেছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। বিধায় একমাত্র রসূল ভিন্ন দ্বীনের ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির অস্থিত্ব নেই বিধায় যারা নেসার ৫৯ আয়াত অনুসারে উলামাগণকে কিংবা উলিল আমরগণকে কিংবা তাবলিগের আমীর গণকে কিংবা তিন পন্থী পীরগণকে কিংবা মসজিদের বেতনভুক্ত ইমামগণকে রসূলের বিকল্প হিসেবে দ্বীনের ক্ষেত্রে আনুগত্য করছে তারা শেরেকে গণ্য আছে। কারণ দ্বীনের ক্ষেত্রে একত্ববাদ ছাড়া তিন পন্থীর কোনো অস্তিত্ব নেই। তিন পন্থী বলতে এখানে আল্লাহ, রসূল এবং পীর। এই তিন তত্ব এসে যায়। সেক্ষেত্রে পূর্ব আলোচনা অনুসারে আল্লাহ ও রসূল একত্ববাদে গণ্য হয়। কারণ রসূলের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্যে গণ্য হয়। কিন্তু রসূল ভিন্ন তৃতীয় ব্যক্তিকে একত্ববাদে আনার কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু আল্লাহ ও রসূলকে একত্ববাদে আনা যাচ্ছে কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে একত্ববাদে আনা যাচ্ছে না বিধায় আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহ বিশ্বাস কর ও রসূল বিশ্বাস কর কিন্তু তিন বলিও না। (সূরা-নেসা, ১৭১ আয়াত)। এই আয়াত অনুসারে তিন পন্থীরা বা তিন পন্থী পীরপন্থীরা বা নায়েবে রসূল পন্থীরা শেরেকে গণ্য। কারণ এই তিন পন্থীরা বলে আল্লাহ তো তিনের ভিতরে একজন (মায়েদা-৭৩)। তারপরও যদি কেউ নেসার ৫৯ আয়াতটি দ্বীনের ক্ষেত্রে তিন পন্থী বা তিন পন্থী পীরপন্থী প্রমাণ করে তাহলে সেই তিনপন্থী বুঝটা নেসার ১৭১ আয়াতের এবং সূরা মায়েদার ৭৩নং আয়াতে পরিপন্থী বলে গণ্য হবে। কিন্তু পবিত্র কোরআনের এক আয়াত আরেকটি আয়াতের পরিপন্থী নয়। এটা নিশ্চিত। তাই নেসার ৫৯ আয়াতে উল্লিখিত উলিল আমরগণের আনুগত্য কর নির্দেশ দিয়ে দ্বীনের ক্ষেত্রে তিনপন্থী প্রমাণ করা থেকে বিরত থাকাই উচিত। বরং নেসার ৫৯ আয়াতে উ্েদ্দশ্য হচ্ছে, উলিল আমরগণের আনুগত্য কর বলতে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণকে আনুগত্য করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন রাজা, বাদশা, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এরাই উলিল আমর। তবে এদের আনুগত্য করার সময় আল্লাহর নিয়তে বা রসূল নিয়তে আনুগত্য করা যাবে না কিংবা এ আনুগত্যে কোনো মাথানত বা সেজদা থাকবে না। বরং এই নিয়ত করা যাবে যে, আমি আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক দুনিয়াবী ক্ষেত্রে এদের আনুগত্য করছি মাত্র। এরা দুনিয়াবী প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত বিধায় উলিল আমরগণের আনুগত্যের নির্দেশটা দুনিয়াবী আনুগত্যের নির্দেশ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন যদি কেউ নেসার ৫৯ আয়াতে উল্লিখিত উলিল আমরগণের আনুগত্যটা দ্বীনের ক্ষেত্রে নেয় তাহলে এই আয়াতের যে উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়াবী আনুগত্যের নির্দেশ সেটা ব্যর্থ হবে। সেক্ষেত্রে আল্লাহর কোনো আয়াতের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার চেষ্টা করলে তার জন্য কঠিন শাস্তি জাহান্নাম। (সূরা-হজ, ৫১ আয়াত)।

দ্বীনের ক্ষেত্রে তিন পন্থীরা বা তিন পন্থী পীরপন্থীরা শেরেকে গণ্য

এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রসূলের আনুগত্য কর এবং উলিল আমরগণের আনুগত্য কর (নেসা, ৫৯ আয়াত)। এই আয়াতের মধ্যে দুই ধরনের আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। (১) একটি হচ্ছে দ্বীনের ক্ষেত্রে আনুগত্য করা, (২) অপরটি হচ্ছে দুনিয়াবী ক্ষেত্রে আনুগত্য করা। এখন আমাদের জানতে হবে, দ্বীনের ক্ষেত্রে আনুগত্য কাকে বলে আর দুনিয়াবী ক্ষেত্রে আনুগত্য কাকে বলে। অর্থাৎ দ্বীনের ক্ষেত্রে আনুগত্য আর দুনিয়াবী ক্ষেত্রে আনুগত্যের পার্থক্য কী? যে আনুগত্য আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে সে আনুগত্যটা দ্বীনের আনুগত্য। কারণ দ্বীনের বিষয়ে সকল কিছু আল্লাহ পাবে (জুমার, ৩ আয়াত) আর যে আনুগত্য দুনিয়াবী শৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষার জন্য করা, সে আনুগত্য দুনিয়াবী আনুগত্য। যেহেতু রসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহর আনুগত্য করা হয় (নেছা, ৮০ আয়াত) সেহেতু রসূলের আনুগত্য দ্বীনের আনুগত্যে গণ্য। পক্ষান্তরে উলিল আমরগণের আনুগত্য করলে সে আনুগত্য আল্লাহর হবে কিংবা রসূলের হবে এমন কোনো আয়াত নেই বিধায় উলিল আমরগণের আনুগত্য দ্বীনের আনুগত্যে গণ্য হচ্ছে না। শুধু দুনিয়াবী শৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে উলিল আমর গণের আনুগত্য করতে বলা হয়েছে বিধায় উলিল আমরগণের আনুগত্য দুনিয়াবী আনুগত্যে গণ্য। এখন আমরা এই দুই আনুগত্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করি। সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দ্বীনের আনুগত্যে সেজদা থাকতে হবে, কারণ সকল দ্বীনের ক্ষেত্রে সকল কিছুই আল্লাহর জন্য। (জুমা, ৩ আয়াত)। এবং সকল সেজদা আল্লাহর জন্য। (সূরা-জিন, ১৮ আয়াত)। আর দুনিয়াবী আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোনো সেজদা থাকবে না। কিন্তু রসূলের আনুগত্যের ভিতরে সেজদা আছে, কারণ আদম রসূল আল্লাহর খলিফা। (সূরা-বাকারা, ৩০ আয়াত)। আর আল্লাহর খলিফা আদম রসূল সেজদা পায়। (সূরা-হিযর, ২৯ আয়াত)। তাহলে রসূলের আনুগত্য সেজদা আছে প্রমাণিত হয়। আমরা জানি সেজদা যেখানে দ্বীন সেখানে। অতএব রসূলের আনুগত্য দ্বীনের আনুগত্যে প্রমাণিত। পক্ষান্তরে উলিল আমরগণের আনুগত্যে কোনো সেজদা নেই বিধায় এদের আনুগত্য দুনিয়াবী ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। কাজেই উলিল আমরগণ কখনো রসূল নয় কিংবা রসূলের বিকল্প নয়। কিংবা এরা নায়েবে রসূলও নয়। আবার সূরা-নেসার ৫৯ আয়াত অনুসারে অনেকেই রসুলের বিকল্প হিসেবে দ্বীনের ক্ষেত্রে উলিল আমরগণের আনুগত্য করে থাকে। এই আয়াতে এসেছে রসূলের আনুগত্য কর এবং উলিল আমরগণের আনুগত্য কর। যেহেতু এই আয়াতে রসূল এবং উলিল আমরগণের মাঝখানে 'এবং' কথা এসেছে, তাহলে দুইজনের আনুগত্য করাই ফরয। যদি দুইয়ের মাঝখানে 'অথবা' কথা আসত, তাহলে উলিল আমরগণ রসূলের বিকল্প হিসেবে প্রমাণ হতো। যেহেতু ঐ আয়াতে দুই এর মাঝখানে এবং কথা এসেছে এতে প্রমাণ হয় যে, উলিল আমরগণ রসূলের বিকল্প নয়। তারপরও নেসার ৫৯ আয়াতটি যখন নাজেল হয়েছে তখনতো নবী (সা.) জীবিত। এই আয়াত নাজিল হওয়ার পরে দ্বীনের ক্ষেত্রে নবী (সা.) এর পরও তৃতীয় ব্যক্তির আনুগত্য করা প্রয়োজন হতো। কেননা এই আয়াতটি তখনকার মোমিনদের জন্য প্রয়োজ্য ছিল। তৎকালীন সময়ে দ্বীনের ক্ষেত্রে নবী (সা.) ভিন্ন অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তির আনুগত্য মোমিনগণ করেছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। বিধায় একমাত্র রসূল ভিন্ন দ্বীনের ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির অস্থিত্ব নেই বিধায় যারা নেসার ৫৯ আয়াত অনুসারে উলামাগণকে কিংবা উলিল আমরগণকে কিংবা তাবলিগের আমীর গণকে কিংবা তিন পন্থী পীরগণকে কিংবা মসজিদের বেতনভুক্ত ইমামগণকে রসূলের বিকল্প হিসেবে দ্বীনের ক্ষেত্রে আনুগত্য করছে তারা শেরেকে গণ্য আছে। কারণ দ্বীনের ক্ষেত্রে একত্ববাদ ছাড়া তিন পন্থীর কোনো অস্তিত্ব নেই। তিন পন্থী বলতে এখানে আল্লাহ, রসূল এবং পীর। এই তিন তত্ব এসে যায়। সেক্ষেত্রে পূর্ব আলোচনা অনুসারে আল্লাহ ও রসূল একত্ববাদে গণ্য হয়। কারণ রসূলের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্যে গণ্য হয়। কিন্তু রসূল ভিন্ন তৃতীয় ব্যক্তিকে একত্ববাদে আনার কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু আল্লাহ ও রসূলকে একত্ববাদে আনা যাচ্ছে কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে একত্ববাদে আনা যাচ্ছে না বিধায় আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহ বিশ্বাস কর ও রসূল বিশ্বাস কর কিন্তু তিন বলিও না। (সূরা-নেসা, ১৭১ আয়াত)। এই আয়াত অনুসারে তিন পন্থীরা বা তিন পন্থী পীর পন্থীরা বা নায়েবে রসূল পন্থীরা শেরেকে গণ্য। কারণ এই তিন পন্থীরা বলে আল্লাহ তো তিনের ভিতরে একজন (মায়েদা-৭৩)। তারপরও যদি কেউ নেসার ৫৯ আয়াতটি দ্বীনের ক্ষেত্রে তিন পন্থী বা তিন পন্থী পীরপন্থী প্রমাণ করে তাহলে সেই তিনপন্থী বুঝটা নেসার ১৭১ আয়াতের এবং সূরা মায়েদার ৭৩নং আয়াতের পরিপন্থী বলে গণ্য হবে। কিন্তু পবিত্র কোরআনের এক আয়াত আরেকটি আয়াতের পরিপন্থী নয়। এটা নিশ্চিত। তাই নেসার ৫৯ আয়াতে উল্লিখিত উলিল আমরগণের আনুগত্য কর নির্দেশ দিয়ে দ্বীনের ক্ষেত্রে তিনপন্থী প্রমাণ করা থেকে বিরত থাকাই উচিত। বরং নেসার ৫৯ আয়াতে উ্েদ্দশ্য হচ্ছে, উলিল আমরগণের আনুগত্য কর বলতে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণকে আনুগত্য করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন রাজা, বাদশা, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এরাই উলিল আমর। তবে এদের আনুগত্য করার সময় আল্লাহর নিয়তে বা রসূল নিয়তে আনুগত্য করা যাবে না কিংবা এ আনুগত্যে কোনো মাথানত বা সেজদা থাকবে না। বরং এই নিয়ত করা যাবে যে, আমি আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক দুনিয়াবী ক্ষেত্রে এদের আনুগত্য করছি মাত্র। এরা দুনিয়াবী প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত বিধায় উলিল আমরগণের আনুগত্যের নির্দেশটা দুনিয়াবী আনুগত্যের নির্দেশ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন যদি কেউ নেসার ৫৯ আয়াতে উল্লিখিত উলিল আমরগণের আনুগত্যটা দ্বীনের ক্ষেত্রে নেয় তাহলে এই আয়াতের যে উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়াবী আনুগত্যের নির্দেশ সেটা ব্যর্থ হবে। সেক্ষেত্রে আল্লাহর কোনো আয়াতের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার চেষ্টা করলে তার জন্য কঠিন শাস্তি জাহান্নাম। (সূরা-হজ, ৫১ আয়াত)।
যেহেতু তিন পন্থী পীর পন্থীরা বা নায়েবে রসূল পন্থীরা শেরেকে গণ্য, ফলে যারা শেরেক করে ওরা মুশরিক। আল্লাহ বলেন, তোমরা মুশরিকগণকে উপেক্ষা কর। (-হিযর, ৯৪ আয়াত)। যেহেতু শেরেক সবচেয়ে বড় পাপ, কারণ শেরেকের অপরাধ ক্ষমা করা হবেনা। (নেসা, ৪৮ আয়াত)। তাই মুশরিকগণ পাপিষ্ঠ। আল্লাহ বলেন, তোমরা পাপিষ্টগণের সঙ্গ ধারণ করিওনা। (দাহর, ২৪আয়াত)। পীর পন্থীরা তিন পন্থী এই জন্য যে, এরা আল্লাহ, রসূল ও পীর এই তিন তত্বে বিশ্বাসী হয়ে একে অপরকে পৃথক করে বা ংবঢ়ধৎবঃব করে বা ফারাক করে বিধায় তিনপন্থীতে গণ্য, যা দ্বীনের ক্ষেত্রে শেরেক। এরা বলে আল্লাহ এই তিনের মধ্যে একজন (সূরা-মায়েদা, আয়াত-৭৩)। কাজেই সূরা-নেসা, ১৭১ আয়াত এবং সূরা-মায়েদা, আয়াত-৭৩ অনুসারে তিন পন্থী পীর পন্থীরা বা নায়েবে রসূলগণ শেরেকে গণ্য। আবার অনেকে নায়েবী রসূল নামে দ্বীনের ক্ষেত্রে তিনপন্থী বুঝ নিয়ে আসে, তাদের জন্য বলতে হচ্ছে যে কারণ সেজদার মালিক আল্লাহ। সূরা-জিন, ১৮ আয়াত। আর আদম আল্লাহর খলিফা (সূরা-বাকারা, ৩০ আয়াত)। তাই আদম সেজদা পায়। (সূরা-হিযর, ২৯ আয়াত)। ইবলিস আদমকে সেজদা না দিয়েই কাফের (সূরা-বাকারা, ৩৪ আয়াত)। মানুষ যখন আদম কাবায় আল্লাহকে সেজদা দিবে তখন সে ইবলিস থেকে পবিত্র হবে। এইভাবে রসূল মানুষকে পবিত্র করেন। (সূরা-বাকারা, ১৫১ আয়াত)। আল্লাহর খলিফার কাবায় সেজদার মাধ্যমে মানুষকে ইবলিসমুক্ত করার লক্ষ্যে আল্লাহ তার খলিফার ধারা অব্যাহত রাখেন এই ভাবে যে, যারা ইমান আনবে এবং সৎকর্ম করবে তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর খলিফা নির্ধারন করেন। (সূরা-নূর, ৫৫আয়াত)। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে রিসালাতের ভার অর্পণ করেন (সূরা-আনআম, ১২৪ আয়াত)। এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক নবী তার শেষাংশে আল্লাহর খলিফা হিসেবে রসূল রেখে যান। (সূরা-ইমরান, ৮১ আয়াত)। সেই রসূলগণ তার শেষাংশে একই প্রক্রিয়ায় আল্লাহর খলিফা হিসেবে পরবর্তী রসূল রেখে যান। রসূল রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর খলিফাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত রাখা। আবার রসূলগণের মাধ্যমে যে রসূলগণ আসছে এরা যদি স্বয়ং আল্লাহর খলিফা না হয় তাহলে সমাজে আল্লাহর খলিফা প্রতিষ্ঠিত থাকছে না। আল্লাহর খলিফা না থাকলে আদম কাবায় সেজদার মাধ্যমে মানুষ ইবলিসমুক্ত হতে পারছে না। আর তাই মানুষকে ইবলিসমুক্ত করার লক্ষ্যে আল্লাহর খলিফা দরকার বিধায় এই রসূলগণই আল্লাহর খলিফা। যেহেতু এই রসূলগণ আল্লাহর খলিফা, সেহেতু এরা কোনো অবস্থায় নায়েবী রসূল নয় বরং এরা তথা সম্যক গুরুগণই স্বয়ং রসূল। এই রাসূলের আনুগত্য করলেই সে আনুগত্য আল্লাহর হবে। (সূরা নেসা : ৮০) অনেকেই উলামাগণকে কিংবা উলিল আমরগণকে, কিংবা তাবলীগের আমীরগণকে, কিংবা পীরগণকে, কিংবা মসজিদের বেতনভুক্ত ইমামগণকে, নায়েবী রসূলজ্ঞানে বিশ্বাস করে থাকে। তাদের এ বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই, কারণ নায়েবী রসূল শব্দ কোরআনে নেই। কাজেই নায়েবী রসূলপন্থী কিংবা তিন পন্থী পীরপন্থী বা তিন পন্থীরা শেরেকে গণ্য। এদের পরিচয় হচ্ছে এরা আল্লাহ ও রসূলকে একাকার ও অবিচ্ছিন্নভাবে বিশ্বাস করে রসূল কাবায় আল্লাহকে সেজদা করে না বিধায় এরা ইবলিসের অনুসারী এতে কোনো সন্দেহ নেই।

জয় গুরু কেন বলি?

৪৮ নং সূরার নাম ফাতহ, আর ফাতহ শব্দের অর্থ 'জয়' (আরবি অভিধান পৃ. ১৮৬১)। অভিধান দিশারি পৃ. ১১২) কাজেই 'জয়' পবিত্র কুরআনের ভাষা। 'জয়' বলতে নিষেধ নেই। আর যিনি কোনো কিছু শিক্ষা দেন তিনিই গুরু বা শিক্ষক আর এখানে গুরু বলতে আমরা আল্লাহকে বুঝি। কারণ আল্লাহর গুণ বাচক নাম 'গুরু' (আররাহমান, ৪ আয়াত)। এই আয়াতে আল্লিম শব্দ এসেছে, যিনি আল্লিম করেন তিনিই মুয়াল্লিম। আর মুয়াল্লিম শব্দের অর্থ শিক্ষক বা গুরু (আরবি অভিধান, পৃ. ২২৭০)। (অভিধান দিশারি, পৃ. ১০৫), যেহেতু আল্লাহ মানুষকে বয়ান বা ভাষা শিক্ষা দেন সেহেতু আল্লাহ গুরু হতে কোন সন্দেহ নেই। আর তাই জয় গুরু দিয়ে আমরা আল্লাহরই জয় কামনা করি। তবে এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, আল্লাহর জয় কামনা করতে গিয়ে তো আল্লাহর জয় বললেই হয়, তবে কেন গুরুনামে আল্লাহকে জয় দিতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, গুরু নামটি দ্বীনের ব্যাপারে আল্লাহর একত্ববাদের নাম এবং গুরু নামটি হচ্ছে আল্লাহর উত্তম গুণবাচক নাম। (বি: দ্র: গুরু নাম একত্ববাদের নাম ও গুরু নাম আল্লাহর উত্তম গুণবাচক নাম এ অধ্যায়ে বিস্তারিত দেখুন)। এজন্যই গুরু নামে আল্লাহর জয় কামনা করা হয়। তাই 'জয়গুরু' বলা হয়।
আবার অনেকে আছে তারা আল্লাহ ও রসূল বিশ্বাস করে, অথচ আল্লাহ ও রসূলকে একাকার ও অবিচ্ছিন্নভাবে অর্থাৎ রসূলের হাতই আল্লাহর হাত এই বিশ্বাস করে না, বরং তারা রসূল থেকে আল্লাহকে ফারাক করে বা ংবঢ়ধৎবঃব করে বা পৃথক করে, তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন-
আল্লাযিনা ইয়াকফুরুনা বিল্লাহি ওয়া রুসুলিহি ওয়া উরিদুনা আইয়ু র্ফারিকু বায়নাল্লাহা ওয়া রুসুলিহি (অর্থাৎ উহারাই আল্লাহ ও রসুল অস্বীকারকারী যাহারা ইচ্ছাকৃতভাবে রসুল থেকে আল্লাহকে ফারাক করে অর্থাৎ রসুল থেকে আল্লাহকে ংবঢ়ধৎবঃব করে বা ফবংঃবহপব করে অর্থাৎ পৃথক করে বা দূরত্ব করে (সূরা নেসা : ১৫০) অর্থাৎ এই আয়াত অনুসারে যারা রসূল থেকে আল্লাহকে ংবঢ়ধৎবঃব করে উহারাই আল্লাহ ও রসূল অস্বীকারকারী কাফের। পক্ষান্তরে যারা রসূল থেকে আল্লাহকে ংবঢ়ধৎবঃব করে না উহারাই মোমিন। এই মর্মে আল্লা আরো বলেন, ওয়া য়াল্লাজিনা আমানুবিল্লাহি ওয়া রসুলিহি ওয়া লাম উফারিরকু বায় আহাদা মিনহুম, উলাইকা সাওফা উতিহিম উযুরাহুম-বরং যারা আল্লার রসুল বিশ্বাস করে এবং উহাদের মধ্যে কোনো ফারাক করে না। অর্থাৎ রসুল থেকে আল্লাহকে ংবঢ়ধৎবঃব করে না বা ফবংঃবহপব) করে না অর্থাৎ পৃথক করে না বা দূরত্ব করে না। উহাদের জন্য রহিয়াছে পুরস্কার (সুরা নেসা আয়াত-১৫২)। এখানে উল্লেখ যে, এই আয়াত দিয়েই অনেকেই প্রমাণ করতে চায় যে, আল্লাহর রসুলের মধ্যে কোন ফরভবৎবহঃ বা পার্থক্য নেই। কিন্তু তাদের কথা ঠিক নহে কারণ আল্লাহ ও রসূলের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। রসুল হচ্ছে সৃষ্ট আল্লাহ হচ্ছে শ্রষ্ঠা। রসুলের জন্ম-মৃত্যু আছে পক্ষান্তরে আল্লাহর জন্ম-মৃত্যু নেই। রসুলের সাথে আল্লাহ আছে। অর্থাৎ রসূল হচ্ছে আল্লাহর সংশ্লিষ্ট। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া রসূল চলতে পারে না পক্ষান্তরে আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নহে আল্লাহ একক। তবে এই আয়াতের উদ্দেশ্য হবে রসুলের সাথে আল্লাহ আছে বিধায় রসুল থেকে আল্লাহকে পৃথক না করে অর্থাৎ ংবঢ়ধৎবঃব না করে আল্লাহ ও রসুল বিশ্বাস করা। আল্লাহ ও রসূলকে একাকার ও অবিচ্ছিন্নভাবে বিশ্বাস করা। রসূলের হাতই আল্লাহর হাত (সূরা আল-ফাতহ-১০) অর্থাৎ রসূল সুরতে আল্লাহ বিশ্বাস করে সেজদা দিলে রসূল সুরতে, স্বপ্নে আল্লাহর দর্শন হয়। কারণ ইবলিশ যেহেতু আদম সেজদার সামিল হয় না (সূরা হিজর-৩৩) সেহেতু স্বপ্নে আদম সেজদাকারীর চেহারায় ইবলিশ আসে না। তখন কিন্তু রসূল সুরতে স্বপ্নে, রসূলও আসে নাই ইবলিশও আসে নাই। রসূল সুরতে স্বপ্নে স্বয়ং আল্লাহই আসে। তখন কিন্তু রসূলরূপে আর রসূল আসে নাই স্বয়ং আল্লাহই আসে। এ মর্মে লালন সাইজি তাঁর গানের ভাষায় বলেছে-যিনি মুর্শিদ/গুরু তিনি রসুল, ইহাতে নাই কোনো ভুল। খোদাও সে হয়, এ কথা বলে না লালন কোরানে কয়। এবার এই মর্মে আল্লাহ বলেন তোমরা যখন রসূলের কাছে যাবে তখন তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এমনটি থাকবে যে আমরা তো আল্লাহর কাছেই গেলাম। যখন তোমরা রসূলের কাছে বায়াত গ্রহণ করবে তখন তো আল্লাহর কাছেই বায়াত গ্রহণ করলে। (সূরা ফাতহ : ১০) কারণ তাদের হাতের উপরই আল্লাহর হাত। (সূরা ফাতহ : ১০) আর এই মর্মে আল্লাহ বলেন, তোমরা যেখানেই থাক না কেন আমি তোমাদের সাথে আছি। (সূরা হাদিদ : ৪)। আল্লাহ তো রসূলের ভেতরই সক্রিয় আছেন। (সূরা আনফাল : ১৭) আল্লাহ মানুষের গর্দানের শাহ রগ অপেক্ষাও নিকটে। (সূরা কাফ : ১৬) (বি. দ্র. একত্ববাদের দ্বীন অধ্যায় ও আল্লাহর অবস্থান সর্বত্রই অধ্যায় বিস্তারিত দেখুন) আল্লাহ মানুষের অতি নিকটে (সুরা বাকারা-১৮৫) যিনি মুর্শিদ/গুরু তিনি রসুল। (বি.দ্র.এই মর্মে সম্যকগুরুই রসুল অধ্যায় বিস্তারিত দেখুন।) অতএব রসূল থেকে আল্লাহকে ফারাক না করে রসূল সুরতে আল্লাহ বিশ্বাস করাই একত্মবাদে দ্বীন। এখানে উল্লেখ্য যে, ফারাক শব্দ অর্থ পৃথক করা। (আরবী অভিধান পৃ. নং ১৮৭৯) আর পৃথক শব্দের ইংরেজি হচ্ছে ঝবঢ়ধৎধঃব। (ইংরেজি অভিধান পৃ. নং ৭০৩) যেটার অর্থ উরংঃধহপব বা দূরত্ব করা বুঝায়। অর্থাৎ সূরা নেসার ১৫০ নং আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে রসূল থেকে আল্লাহ ঝবঢ়ধৎধঃব বা উরংঃধহপব না করে বিশ্বাস করা। বরং রসূলের হাত আল্লাহর হাত বিশ্বাস করে রসূলের মধ্যে ব্যক্তি রসূলকে বিলীন করে সেই সুরতে আল্লাহ বিশ্বাস করে সেখানে আল্লাহকে বর্তমান জেনে সেজদা করা হয়। এটাই হচ্ছে রসূলের মাধ্যমে ঈমান পরীক্ষা করা। (সূরা ফুরকান : ২০) উপরোক্ত আলোচনায় দেখা গেলো যারা রসুল থেকে আল্লাহকে ফারাক করে বা ঝবঢ়ধৎধঃব (পৃথক) করে উহারা সুরা নেসার ১৫০নং আয়াত অনুসারে আল্লাহ ও রসুলকে অস্বীকারকারী বলে গণ্য। তাই উহারা যখনই রসুল থেকে আল্লাহকে ঝবঢ়ধৎধঃব বা পৃথক করে তখনই উহারা আল্লাহর সাথে রসুলের নাম জপনা করে। ফলে উহারা সুরা জিনের ১৮নং আয়াত অমান্যকারী বলে গণ্য হয়। (কারণ এই আয়াতে বলা হয়েছে তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে ডেকো না।)
বিধায় এরাও ইবলিসের অনুসারী তাই এরা 'জয়গুরু' বলে না। (বি: দ্র: এই পুস্তকে রসূলের কোন বিকল্প নেই অধ্যায় বিস্তারিত দেখুন)।
এখন আমরা বুঝলাম, গুরু নাম একত্ববাদের নাম, গুরু নাম আল্লাহর উত্তম গুণবাচক নাম, গুরুনামে যারা আল্লাহ পাকের জয় কামনা করেনা, তারা দ্বীনের ব্যাপারে কেউ দ্বি-পন্থী, বা কেউ তিনপন্থী শেরেকবাদী এটা বুঝলাম, কিন্তু আর একটা প্রশ্ন থাকে যে, 'জয়' কথাটা সাধারণতঃ যুদ্ধক্ষেত্রে বা পক্ষে বিপক্ষে প্রতিযোগীতার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। কিন্ত দৈনন্দিন জীবনে তো যুদ্ধ নেই, তাহলে কেন জয় কথাটা ব্যবহার করা হবে? আবার আল্লাহ পাকের জয় কামনা করার ক্ষেত্রে আল্লাহর জয় কামনা আমরা কেন করব, কারণ আল্লাহতো সর্বশক্তিমান ও সর্বশ্রেষ্ঠ, তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তিনিতো সর্ব বিষয়ে সার্বক্ষণিক জয়ী, আবার জয়গুরু দিয়ে আল্লাহর জয় কামনা করার দরকার কী? এই বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করি। আল্লাহর সমকক্ষ কেউ নেই, কিন্তু আল্লাহর প্রতিপক্ষ আছে, আল্লাহর সেই প্রতিপক্ষ হচ্ছে ইবলিস। ইবলিস মানুষকে কুমন্ত্রণা দিয়ে পথভ্রষ্ট করার লক্ষ্যে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও অবকাশ প্রাপ্ত। আল্লাহ বললেন, 'কিয়ামত দিবস পর্যন্ত এই কর্মের জন্য তোমাকে অবকাশ দেয়া গেল। (হিযর, ৩৬ আয়াত)। কিন্তু সাথে সাথে এটাও জানিয়ে দিল যে, তাগুত ইবলিসকে বর্জন করে মানুষ আল্লাহর এবাদত করবে এই উদ্দেশ্যে আমি রসূল পাঠালাম। (নাহল, ৩৬ আয়াত)। সেই থেকে রসূল আল্লাহর পক্ষে ইবলিসের বিপক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত আছে। এই যুদ্ধ হচ্ছে নিজের নফসের সাথে যুদ্ধ। ইবলিস মানুষের কাছে পাপ কর্মকে শোভন করে ধরে। (হিযর, ৩৯ আয়াত) এবং মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। (ক্বাফ, ১৬ আয়াত)। ইবলিসের কুমন্ত্রণার সাথে যুদ্ধ করে জয় লাভ করলেই প্রভুর নৈকট্য হাসিল হবে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, "হে মমিনগণ, তোমরা যুদ্ধ করে জয়ী হলে অবশ্যই প্রভুর নৈকট্য লাভ করবে।" (মায়েদা, ৩৫ আয়াত)। সেই থেকে মমিনগণ ইবলিসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আছে, কেউ কেউ এই নফসানী যুদ্ধে জয়লাভ করে ইবলিসের প্রতিপক্ষ রসূলের সঙ্গ ধারণ করে প্রভুর পক্ষে জয়ের পথকে ত্বরান্বিত করেছেন। এই ভাবে প্রত্যেক মানুষই আমরা প্রতিনিয়ত ইবলিসের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আছি। এই যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমেই জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। দ্বীনের ক্ষেত্রে ইবলিসের সাথে যুদ্ধ করাই একটা উত্তম বাণিজ্য। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, এই যেহাদই হচ্ছে তোমাদের জন্য উত্তম বাণিজ্য, যা তোমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রেহাই দিবে। (নং-৬১ আয়াত ১১)। যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে তাদেরকে আল্লাহ তার পথেই পরিচালিত করেন। (সূরা-আনকাবুত, আয়াত-৬৯)। এইজন্য আমাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের সাথে জয়-পরাজয় কথাটা জড়িয়ে আছে, তাই সেই লক্ষ্যেই আমরা ইবলিসের পরাজয় এবং প্রভুর জয় কামনা করি। এই মর্মে আল্লাহর দলের জয় কামনাই পবিত্র কোরআনের ভিতরে নিম্নলিখিত আয়াতগুলির সন্ধান পাওয়া যায়।
আল্লাহ বলেন, সকল দ্বীনের উপরে এই একত্ববাদের দ্বীন তথা রসূল তত্বের এই দ্বীনের জয় হউক, (নং-৬১ আয়াত ৯)। যারা জয় গুরু বলে, এরাই হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত একত্ববাদ দ্বীনের দল। অর্থাৎ আল্লাহর দল। এদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, তোমরা নিশ্চিত থাক যে, আল্লাহর দলের জয় হবেই। (মায়েদা, ৫৬ আয়াত)। জয়গুরু বলা যদিও একত্ববাদের দ্বীন, তথাপিও মুশরেকরা এটাকে অপ্রীতিকর মনে করে। তারপরও আল্লাহ বলেন, সমস্ত দ্বীনের উপর এই একত্ববাদের দ্বীনের জয় হবেই। (তওবা, ৩৩ আয়াত)। এজন্য পথ নির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ আল্লাহ রসূলকে পাঠিয়েছেন। (তওবা, ৩৩ আয়াত)। এই একত্ববাদের দ্বীনকে যারা প্রত্যাখ্যান করছে, তাদের বিরুদ্ধে জয় কামনা করা। সকল ধর্মের উপর এই একত্ববাদের দ্বীনকে জয়যুক্ত করার জন্য রসূলগণ এসেছেন। (ফাতহ, ২৮ আয়াত)। যারা এই সত্য দ্বীনকে বিরোধিতা করে তারা কাফের। কাফেরের বিরুদ্ধে সাহায্য কামনা করা। (বাকরা, ২৮৬ আয়াত)। এইজন্য কাফেরদের বিরুদ্ধে তোমাকে স্পষ্ট বিজয় দান করা হয়েছে। (ফাতহ, ১আয়াত)। সকল বিজয় আল্লাহর হাতে, তোমরা আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হও, এবং এই একত্ববাদের দ্বীনে প্রবেশ কর, অবশ্যই জয়লাভ করবে (মায়েদা, ২৩ আয়াত)। আর আল্লাহ যদি সাহায্য করে তোমাদের উপর জয়ী হবার কেউ থাকিবে না (ইমরান, ১৬০আয়াত)। মমিনদের জয় হলে মুনাফিকরা বলে, আমরাওত তোমাদের সাথেই ছিলাম, (নিসা, ৪১আয়াত)। যার যার দ্বীনের সেই সেই জয় কামনা কর। (ইব্রাহীম, ১৫আয়াত)। আল্লাহর সিদ্ধান্ত যে, আল্লাহর দল অবশ্যই বিজয়ী হবে। (মুজাদালা, ২১ আয়াত)। তোমরা আশাবাদী হও, হয়ত আল্লাহ অবশ্যই জয় দিবেন। (মায়েদা, ৫২আয়াত)। প্রত্যেকেই তাদের কর্মক্ষেত্রে জয় কামনা করে, যেমন যাদুকরগণ মুছার বিরুদ্ধে জয় কামনা করল। (শুআরা, ৪৪ আয়াত)। আল্লাহ বলেন, যারা আমার বাহিনী হবে, তারা অবশ্যই জয়লাভ করবে। (নং-৩৭, আয়াত ১৭৩)।
উপরিউক্ত আয়াতগুলোতে জয় কামনা করে আল্লাহ ঘোষণা করেছে বিধায় 'জয়গুরু' দিয়ে আল্লাহ পাকের জয় কামনা করলেই আমরা বিধর্মী হবো, এমন চিন্তা অজ্ঞতার সামিল। তার পরেও পরস্পর দেখা হলে আমরা 'জয়গুরু' কেন বলি? একজন মানুষকে দেখে 'জগগুরু' বলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রত্যেক মানুষ তার কৃতকর্মের কারণে ইবলিস স্বভাব দ্বারা শৃংখলিত আছে, পরবর্তী পুনর্জীবিত করার দিবস পর্যন্ত। (নং-২৩, আয়াত-১০০)। এখানে পুর্নজীবিত দিবস বলতে মৃত্যুর পরে পুর্নজীবিত করে যখন তার প্রভুর কাছে নিয়ে যাওয়া হবে (নং- ৬, আয়াত-৬২) এবং (নং- ৩২, আয়াত-১১)। সেই দিবস আসার পূর্বেই যেন মানুষ তার মধ্যে ইবলিস স্বত্তাকে পরাজিত করে প্রভু সত্তার জাগরণ ঘটিয়ে প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিতে পারে। (নং-৪২ আয়াত- ৪৭)। সেই লক্ষ্যে প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতেই তার মধ্যে প্রভু স্বত্তার জয় কামনা করা হয় বিধায় জয়গুরু বলা হয়। এই ব্যাপারে যারা নিজের ভিতরে ইবলিস স্বত্তাকে পরাজিত করে প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, তোমরা তোমার প্রভুর উত্তম প্রশংসা কর। (নং- ৮৭, আয়াত-১৫)। কারণ প্রভুতো তোমাকে বিজয় দান করেছে। (নং-৪৮, আয়াত-১)। অতঃপর তুমি তোমার প্রভুর উত্তম প্রশংসা কর। (সূরা-কাউসার, আয়াত-২)। এই সকল আয়াতে উসাল্লি শব্দ এসেছে, উসাল্লি শব্দের অর্থ উত্তম প্রশংসা করা। আরবি অভিধান পৃ. ১৬০৭)। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য ঘটনাকে জয় বলে। তাই প্রভুর প্রতি উত্তম প্রশংসা বলতে 'জয়গুরু' শব্দকে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ জয় হচ্ছে প্রশংসা আর গুরু হচ্ছে আল্লাহর উত্তম নাম। তাই 'জয়গুরু' দিয়ে প্রভুর উত্তম প্রশংসা ব্যক্ত করা হয়েছে। কারণ 'জয়গুরু'টা হচ্ছে প্রশংসামূলক শব্দ এবং উসাল্লি শব্দটাও প্রশংসামূলক শব্দ। উসাল্লি প্রশংসামূলক শব্দ এই জন্য যে, আল্লাহ তার বান্দার প্রতি উসাল্লি আদায় করে। (আহযাব, আয়াত-৪৩)। যেহেতু আল্লাহ তার বান্দার প্রতি উসাল্লি আদায় করে সেহেতু উসাল্লি শব্দ কখনো উপাসনামূলক হতে পারে না বরং এটা প্রশংসামূলক। তাই যে সকল আয়াতে প্রভুর প্রতি উসাল্লি আদায় করতে বলা হয়েছে সেসকল আয়াতগুলির ভাবার্থই প্রভুর জয় কামনা করার নির্দেশ প্রতিফলিত হয়েছে। তাই সেসকল আয়াত অনুসারে প্রভুর উত্তম প্রশংসা করার নির্দেশ এসেছে, তাই প্রভুর উত্তম প্রশংসা করার লক্ষ্যে গুরুনামে প্রভুর জয় কামনা করা। তাই মমিনগণ 'জয়গুরু' বলে থাকেন। এখানে আর একটি প্রশ্ন থাকে যে, যেহেতু উসাল্লি প্রশংসামূলক শব্দ আর এই উসাল্লি আয়াতগুলো দিয়ে প্রভুর প্রতি উত্তম প্রশংসা করার নির্দেশ আসছে আর সেই অনুসারে মানুষ আল্লাহর উত্তম প্রশংসা করবে এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহর প্রশংসা করার ভাষা হচ্ছে, সুবহানআল্লাহ ওয়া বিহামদীহি, অথবা আলহামদুলিল্লাহ। কিন্ত প্রভুর উত্তম প্রশংসার ক্ষেত্রে এই শব্দগুলো ব্যবহার না করে 'জয়গুরু' বলে প্রভুর উত্তম প্রশংসা করার যুক্তি কী? এই বিষয়ে যুক্তি হচ্ছে, ইবলিস সুবহানআল্লাহ ওয়া বিহামদীহি শব্দ দিয়ে আল্লাহ পাকের মহিমা বর্ণনা করে। (নং-হাদীদ, আয়াত- ১) (নং-হাশর, আয়াত- ২৪)। (সূরা-তাগাবুন, আয়াত- ১)। ইবলিস যে শব্দ দিয়ে আল্লাহ পাকের মহিমা বর্ণনা করে সেই শব্দ ব্যবহার করলে ইবলিসের অনুসারী বলে গণ্য হবে। বিধায় মোমেনগণ প্রভুর উত্তম প্রশংসার ক্ষেত্রে 'জয়গুরু' বলে থাকে। কারণ ইবলিস কখনোই 'জয়গুরু' বলা সমর্থন করে না। যারা 'জয়গুরু' বলে না তারাই ইবলিসের অনুসারী এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা সেদিন বলবে, আমরা উসাল্লি আদায়কারীদের (অর্থাৎ জয়গুরু দিয়ে প্রভুর উত্তম প্রশংসা আদায়কারী) অর্ন্তভুক্ত ছিলামনা। (মুত্তাছিল, আয়াত-৪৩)।
আর একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, বান্দা তার প্রভুর ইবাদত করবে, অর্থাৎ উপাসনা করবে আর প্রভুর প্রশংসা করবে। এখানে উপাসনা ও প্রশংসার মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। আর সেটা হচ্ছে এই যে, উপাসনা করার একটা সময়সীমা আছে, পক্ষান্তরে প্রশংসা করার কোনো সময় উল্লেখ নেই। অর্থাৎ উপসনা করা একসময় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু প্রশংসা করা শেষ হয় না। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি নিশ্চিত বিশ্বাসী না হও, ততক্ষণ পর্যন্ত ইবাদত কর। (হিযর, আয়াত- ৯৯)। অর্থাৎ বান্দা যখন আমানু স্তর পার হয়ে একিন স্তরে পৌছায় তখন বান্দা শুধু প্রভুর প্রশংসাই করবে, আর এই স্তরের ব্যক্তিগণ শুধু আল্লাহকেই ভালোবাসে। আর আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসে (সূরা-মায়েদা, আয়াত-৫৪)। আর তাই তারা শুধু প্রভুর প্রতি উসাল্লি আদায় করার লক্ষ্যেই সর্বকর্মে সর্বস্তরে সার্বক্ষণিকভাবে 'জয়গুরু' ব্যক্ত করে থাকেন। তাই বলা যায় যারা সারাক্ষণ 'জয়গুরু' বলে তাহলে জানবে তারা আমানু স্তর পার হয়ে একিন স্তরে পৌছে গেছে এটা নিশ্চিত। তবে যারা আমানু স্তরে আছে তাদের জন্য সালামের বিধান আছে (সুরা আনাম-৫৪)। তবে সালাম দেওয়া নেওয়ার সাথে জয়গুরু বলার কোন বিরোধ নেই বা সম্পর্ক নেই বিধায় সালাম আদান-প্রদান করতে কোন বাধা নেই। তবে যারা আমানু স্তর পার হয়ে কে একিন স্তরে পৌছে গেছে তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য জয়গুরু বলার প্রয়োজন।
এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, আমরা চলতি পথে 'জয়গুরু' বলি কেন? এর কারণ হচ্ছে, তোমার দ্বীনের অনুসরণ যারা করে তাদেরকে পরীক্ষা করে নেওয়ার জন্য 'জয়গুরু' বলা হয়। কারণ আল্লাহ বলেন তোমার দ্বীনের অনুসরণ যে করে তাকে ব্যতীত অন্য কাউকে বিশ্বাস করিও না (সূরা-ইমরান, আয়াত- ৭৩)। সুতরাং তোমরা অবশ্যই পর্ক্ষীা করে নিবে। (সুর-নেছা, আয়াত- ৯৪)। যেহেতু ইবলিস জয়গুরু বলে না তাই ইবলিসের অনুসারীদেরকে পরীক্ষা করে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই 'জয়গুরু' বলা হয়।
সম্যক গুরুই রসূল। আর বান্দা নফসানী যুদ্ধে জয় লাভ করে সম্যক গুরুর সঙ্গ ধারণ করে আমানু স্তর পার হয়ে একিন স্তরে পৌছে, প্রভুর প্রতি উসাল্লি আদায়ের লক্ষ্যে দ্বীনের একত্ব বাদের নাম ও আল্লাহর উত্তম গুণবাচক নাম গুরু নামের মাধ্যমে প্রভুর উত্তম প্রশংসা ব্যক্ত করে, তাই জয়গুরু বলে। সত্য মিথ্যা পার্থক্য করার জন্যই এই কুরআন (সুর-বাকারা, আয়াত- ১৮৫)। তাই এই কুরআনে একটি বিষয় আল্লাহ বিভিন্ন ভাবে ব্যক্ত করেছেন, তাতে তারা অনুধাবন করতে পারে। (সুর-আনআম, আয়াত- ৬৫)। বিষয় ভিক্তিক কুরআনের আলোকে একটি বিষয় অনুধাবন করা আমাদের সকলের কর্তব্য।