মঙ্গলবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৯

কায়েমী সালাত সম্পর্কে আলোচনা

নামায প্রতিষ্ঠিত করা সময়ের দাবী 

প্রথমেই জানা দরকার কায়েম অর্থটি তারপর জানা দরকার কিভাবে কায়েম হবে? কায়েম শব্দটি অভিধানিক বাংলা অর্থ হচ্ছে- অবিরত, প্রতিষ্ঠিত, খাড়া, এবং সর্বদা। আপনি আরবী হইতে বাংলা অভিধানটি খুললেই আমার সাথে দ্বিমত করার কোন সুযোগ পাবেন না। আমাদের আলেম সাহেবগন মাদ্রসার শিশুদের ছোট বেলা থেকে শিক্ষা দিয়ে আসছেন ৫ ওয়াক্ত নামায জামাতের সহিত পড়াই হলো কায়েম করা। নিজে পড়া এবং সবাইকে নিয়ে জামাতে পরার নামই কায়েম করা। হাঁয়রে কপাল! আল্লাহ পবিত্র কোরআনের একাধিক বারই বলেছেন যার যার বোঝা তাকেই বহন করতে হবে। তবে জামাতে নামায আদায় করলেই কায়েম হবে কি করে? কায়েম শব্দটি যেহেত অবিরত সেহেতু আপনার নামাযের সাথে তো আমার নামায শুরুও হয় না শেষও হয় না। যে ওয়াক্তে আমি বাড়িতে থাকি তবে তো আপনাদের নামায কায়েম হয় না যেহেতু আমাকে সামিল করতে পারেন নাই। আর যার যার কায়েমী নামায যদি তার তার হয় তবেই সেটা কায়েম করা সম্ভব। কারণ আল্লাহ বলেছেন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সালাত(উপাশনা/স্মরণ) কায়েম করতে। আমরা একসাথে জন্মাইও না মরবোও না। আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই কায়েম যার যার তার তার যেমন আল্লাহ কোরআনে বলেছেন যার যার বুঝা তার তার। কায়েম কিভাবে হয় সেটা আমি আলোচনা করবো তার আগে একটি গল্প।

আমাদের এলাকার এক মসজিদের সেক্রেটারী জুম্মার নামাজের জন্য খতিব খুজচ্ছেন এবং প্রতি জুম্মায় ইন্টার্ভিউও নিচ্ছেন এমনিতেই কয়েক মাস পার করে দিলেন। তার চোখে ভাল খতিব পরছে না, তাই খতিব নির্ধারন করতে পারছেন না। জানতে চাওয়া হল খতিবের ইন্টার্ভিউ কে নিবে। জবাবে, তিনি বললেন আমরাই নিবো। আপনি কি আরবীর ভাল জ্ঞান রাখেন? বললেন আমি আরবী জানি না, তবে শুনলেই বুঝতে পারবো! গ্রামে একটা কথা প্রচলন আছে শুটকির নৌকা বিড়াল চৌকিদার। এই হলো আমাদের দুর্ভাগ্য। আর যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তারা শুধু ফটর ফটর আরবী বলে যান তারা অর্থ কিছু বলতে পারেন না। এই জন্যই নামাজ কায়েম করার এই অবস্থা। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা মরিয়াম এর ১৯:৩১ নং আয়াতে সালাত কায়েম করতে বলেছেন জন্ম হইতে মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত অবিরতভাবে, নির্বিছিন্ন, বিরতিহীন ভাবে। কই আমরা তা করছি? মনে করেন কেউ এশার নামায আদায় করতে লাগে ১৫,২০,২৫ মিনিট বৃদ্ধ মানুষের বেশীর মধ্যে ৩০ মিনিট তাহলে কিভাবে সমতা হয়। আমি সাধারন ভাবে আলোচনার মাধ্যমে কায়েম শব্দটি ব্যাখ্যা করে বুঝাতে চাই।

১/ একটি শিশু মাতৃগর্ভে ৯ মাস ১০দিন কায়েম থাকার পর ভুমিষ্ট হয়। শিশুটি কিন্তু সব সময়ের জন্যই মায়ের পেটেই থাকে সে কিন্তু মাঝে মাঝে বের হয় না বাচ্চাটি স্থায়ী সেখানে। ২/ সরকারী অফিস টাইম সকাল ৯টা হতে ৫টা এই সময়টুকু সরকারী চাকুরীজীবিদের জন্য কায়েমী সময়। সরকারী কর্মচারীদের জন্য ঐ অফিস সময়টা অন্য কোন কাজ করা বৈধ নয় পিয়ন থেকে শুরু করে উর্ধতন কর্মকর্তা পর্যন্ত।

১৯:৩১ নং আয়াতে আল্লাহর কায়েমী সময়টা হচ্ছে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। আল্লাহ কোরআনে যেখানেই নামায় কায়েম করার কথা বলেছেন সাথে যাকাতের কথাও বলেছেন। তবে একটি কথা আল্লাহর সালাত যারা কায়েম করে তারা সাথে সাথে যাকাতও আদায় করেন। কারণ আকিমুস সালাত আর ওয়াতুস যাকাত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সালাতের জন্য আল্লাহ কোন ওযু গোশলের কোন শর্ত দেন নাই। কিন্তু ওয়াক্তিয়া সালাতের পূর্বে আল্লাহ ওযু গোশলের কথা বলেছেন। যা কিনা সূরা মায়িদার ৫:৬ নং আয়াতটি দেখলেই আপনি পরিষ্কার হতে পারবেন। নিজ জ্ঞানে বিচার করে বুঝের জন্য কোরআনের আয়াত গুলি দেখার অনুরোধ করছি আপনাদের জন্য নিচে আয়াতগুলি উল্লেখ করছি। দুইটি আয়াত পড়ে সহজেই বুঝা যায় নামায পড়া আর কায়েম করা এক জিনিষ নয়।

১৯:৩১ # ‘আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন নামায কায়েম ও যাকাত আদায় করতে।’

৫:৬ # ‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং পদযুগল গিটসহ। যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি তোমরা রুগ্ন হও, অথবা প্রবাসে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রসাব-পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও-অর্থাৎ, স্বীয় মুখ-মন্ডল ও হস্তদ্বয় মাটি দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না।’

আসলে সালাত (নামাজ) পড়ার মত কোন বিষয়ই নয়। এটা কোন কিতাবও নয় জামা-কাপরও নয় যে প্রচলিত শব্দ ‘পরবে’ ব্যবহার করা যাবে। সালাত (নামাজ)আদায় করতে হবে নয়তো কায়েম (খাড়া) করতে হবে। সালাত অর্থ তো স্মরণ বা উপাসনা। সূরা নিসার এবং আল ইমরানের দুটি আয়াত
৪:১০৩# যখন তোমরা নামায সম্পন্ন কর, তখন দন্ডায়মান, উপবিষ্ট ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ কর। ৩:১৯১# যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষযে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। এই আয়াত দুটির দিকে খেয়াল করলেও বুঝা যায় সালাতের আলাদা আলাদা প্রকার ভেদ।

কায়েম শব্দের অর্থ যেহেতু অবধারিত। আল্লাহ প্রদত্ত কায়েমী কিছু বর্জন করার সাধ্য কার আছে? আল্লাহ বৃষ্টি না দিলে কেউ কি বৃষ্টি নামাতে পারবেন? এমনকি আল্লাহ তিনদিন যাবৎ অবিরত বৃষ্টি দিলে কেউ থামাতেও পারে না! আল্লাহ প্রদত্ত কায়েমী কোন কিছু বর্জন করার উপায় নাই। তা আমরা সূরা হজ্জ এর ২২:১৮ নং ‘তুমি কি দেখনি ইচ্ছায় এবং অনিচ্ছায়, আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু আছে নভোমন্ডলে, যা কিছু আছে ভুমন্ডলে, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি পর্বতরাজি বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং কিছু সংখ্যক মানুষ।’

এই আয়াতে স্পষ্ট আছে আল্লাহর হুকুম ইচ্ছায় অনিচ্ছায় পালন না করার কোন উপায় নাই। কিন্তু উক্ত আয়াতটিতে আল্লাহ এও বলছেন কিছু সংখ্যক মানুষ সব মানুষের কথা বলেন নাই। এতে আমি বুঝতে পারছি সব সৃষ্টিই বস্যতাস্বীকার করছে। মানুষের মধ্যে যারা বুঝে করছে তারা মানুষের অন্তর্গত আর যারা না বুঝে করছে তারা মানুষের অন্তর্গত নয়। আমার কথায় রেগে আফসোস করবেন না যে কেন কষ্ট করে পড়লাম। আমি মন গড়া কথা বলছি না। সূরা আনামের ৬:৩৮# ‘আর যত প্রকার প্রাণী পৃথিবীতে বিচরণশীল রয়েছে এবং যত প্রকার পাখী দু’ ডানাযোগে উড়ে বেড়ায় তারা সবাই তোমাদের মতই এক একটি উম্মত(জাতি)।’ অবলা প্রানী জগৎ থেকে যারা নিজেদের আলাদা করতে পেরেছেন। তারাই কায়েমী নামাযের সন্ধান পেয়েছেন।

মুসলমানদের মধ্যে শরিয়তের আলেমগন বলেন সকলকে নিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করাই কায়েম করা। এটা যে সঠিক নয় উপরের আলোচনায় বুঝাতে চেষ্টা করেছি। আর একদল আছেন মারেফতের অনুসারী তারা বলেন যার যার ওলিল আমর অর্থাৎ পির। পিরের চেহারা ধ্যান করার নামই স্মরণ। যেটা একেবারেই কোরআন বিরোধী কাজ কুফরী শেরেকি গুনাহ। আল্লাহর সমকক্ষ দাড় করানোকারীদের আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।

কায়েমী নামাজ সঠিক হওয়ার জন্য বায়াত হওয়াও জরুরী এটাও রাছুল সা. এর হাদীস থেকে পাওয়া যায়। হাদিসটি বুখারী শরীফের থেকে উল্লেখ করছি নিম্নে। ইসলামি ফাউন্ডেশন হইতে প্রকাশিত বুখারী শরীফ থেকে গৃহীত ৪৯৯ নং উল্লেখ আছে ‘মুহাম্মদ ইবনুল মুছান্না (র.) জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ এর নিকট সালাত আদায়, যাকাত প্রদান এবং প্রত্যেক মুসলমানকে নসীহত করার জন্য বায়আত গ্রহন করেছি।’
আপনাদের কাছে আকুল আবেদন রইল যেভাবে সালাত কায়েম হয় সে রাস্তা খুজে বের করুন যে জানেন তার কাছে যাওয়াও আল্লাহরই হুকুম।-২১:৭ আয়াত।

হুজুরী দীল ছাড়া নামাজ

আলহাজ মাওলানা হযরত সৈয়দ জাকির শাহ্ নকশবন্দি মোজাদ্দেদি কুতুববাগী

আল্লাহতায়ালা বান্দাদের ওপর তাওহীদের পর নামাজ হইতে অধিক প্রিয় আর কোন জিনিস ফরজ করেন নাই।

পবিত্র কোরআনের সূরা আন্‌কাবূত-এর ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওয়া আক্বিমুস্ব্ স্বালা-তা ইন্নাস্ব স্বালা-তা তান্‌হা আনিল্ ফাহ্শা ই ওয়াল্ মুনকার’।অর্থ: নামাজ কায়েম কর, নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে পাপের কাজ হইতে বাঁচাইয়া রাখে’। বর্তমানে অধিকাংশ নামাজীদেরই কী রকম অবস্থা তাহা একটু চিন্তা করিয়া দেখুন। অনেক নামাজী নামাজ পড়ে, আবার তারা ঘুষ গ্রহণ করে, রেশওয়াত, মিথ্যা, ধোঁকাবাজী করে, পরকে ঠকায়। এসব গুনাহ্য়ে কবিরা ও গুনাহ্য়ে ছগিরা। মোট কথা যত প্রকার গুনাহ্ আছে, এর সবই অনেক নামাজীগণ করিতেছে। কোন রকম গুনাহ্ই নামাজী বাদ দিতেছে না। আল্লাহতায়ালা বলিতেছেন, নামাজ নামাজীকে কঠিন গুনাহ্র কাজ হইতে বাঁচাইয়া রাখে। কিন্তু এখন নামাজ যে গুনাহ্র কাজ হইতে বাঁচাইয়া রাখে না, ইহার কারণ কী? আল্লাহতায়ালা তবে কি মিথ্যা কথা বলিয়াছেন? (নাউজুবিল্লাহ)। না, আমরা মূলে নামাজই পড়িতেছি না, আল্লাহতায়ালা কখনো অসত্য বলিতে পারেন না। বরং আমরা হাকিকতে নামাজই পড়িতেছি না। আমরা অধিকাংশই কেবলমাত্র সমাজ রক্ষা করিয়া আসিতেছি। এই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত (নামাজ) আমরা কিভাবে সম্পূর্ণ করিয়া থাকি, তাহা নিজে নিজে গভীরভাবে চিন্তা করিলে বুঝিতে পারিবেন। দায় ঠেকাভাবে কি আমরা এই নামাজ পড়ি না! মাথার বোজা নামাইয়া ফেলার মত কি আমরা নামাজ আদায় করি না? লোকলজ্জার ভয়ে, সমাজের ভয়ে, গুরুজনের ভয়ে কি আমাদের অনেকের নামাজ পড়া হয় না? তবে কী করিয়া সে নামাজ আমাদিগকে নানা প্রকার গুনাহ্র কাজ হইতে বাঁচাইবে? নামাজে হুজুরী দিল না হইলে পুরুষ ও মেয়েলোক কাহারও নামাজ শুদ্ধ হইবে না। অর্থাৎ, নামাজের মধ্যে মন সর্বদা খোদার ধ্যানে একাগ্র না হইলে নামাজ শুদ্ধ হইবে না। কেননা, সহিহ্ হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘লা ছালাতা ইল্লা বিহুজুরীল ক্বালব’। অর্থ: হুজুরী দিল ব্যতীত নামাজ শুদ্ধ হয় না’। মনে সর্বদা খোদাতায়ালার ধ্যান থাকা ও তাহার প্রেম ও ভালোবাসা ব্যতীত নামাজ শুদ্ধ হয় না। আল্লাহতায়ালা কোরআন শরীফে আর একস্থানে ফরমাইয়াছেন, ‘ফামন কানা ইয়ারজু লিক্বা আ রাববিহী ফাল্ ইয়া’ মাল্ স্বা-লিহাও ওয়ালা- ইউশর্কি বি ইবা-দাতি রাববিহী আহাদা’। অর্থ: যে ব্যক্তি তাহার পালনকর্তার সহিত সাক্ষাত ও তাহার দিদারের আশা রাখে, তাহার উচিৎ যে, সে যেন নেক কাজ করে ও তাহার পালনকর্তার ইবাদতে কাহাকেও শরিক না করে’। (সূরা : কাহাফ, আয়াতÑ ১১০)। বর্তমানে নামাজীদের নামাজের কী অবস্থা তাহা একটু চিন্তা করিয়া দেখুন। আমরা সূরা ফাতেহা (আলহামদু)তে যখন পাঠ করি ‘ইয়াকা না-বুদু ওয়াই-য়াকা নাস্তাইন’ (অর্থ : আমি তোমারই বন্দেগী করি ও তোমারই নিকট সাহায্য প্রাথনা করি), পড়ি, তখন কাহার কথা বা কাহার রূপ ধ্যানে থাকে এবং এই কথা কাহাকে বলা হয়। প্রায়ই দেখা যায়, যে যাহা ভালোবাসে বা যাহার চিন্তা দিলে পোষণ করে, তাহার কথাই তখন তাহার ধ্যানে আসে। বরং অন্য সময় অপেক্ষা নামাজের মধ্যেই নানা প্রকার সাংসারিক চিন্তা ও বাজে বাহুল্য বিষয় হৃদয়ের ভিতরে আরও বহুগুণে বেশি ঘনীভূত হইয়া উপস্থিত হয়। এমনকি অনেক সময় নামাজের রুকু, সেজদা, তসবিহ্ ও বৈঠক রীতিমত হয় না। এই প্রকার ভুল ও বেখেয়ালী নামাজীকে শাস্তির সংবাদ দিয়া আল্লাহতায়ালা (সূরা মা‘উন-এর ৪, ৫ ও ৬ নং আয়াত) ফরমাইয়াছেনÑ ‘ফাওয়াইলুল লিল মুস্বাল্লীন’। ‘আল্লাযীনা হুম আন স্বালা তিহিম সা-হূন’। ‘আল্লাযীনা হুম ইউরা- ঊন’। অর্থ: যে মুসল্লি (গায়ের-আল্লাহর চিন্তায়) নামাজে ভুল করে, তাহার জন্য দোজখের ঐ স্থান যাহার নাম ‘ওয়ায়েল’ এবং তাহার জন্য যে ‘রেয়া’ (লোককে দেখানোর জন্য এবাদত) করে।

হযরত নবী করীম (সঃ) ফরমাইয়াছেন, ‘সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট চোর ঐ ব্যক্তি, যে নামাজে চুরি করে। অর্থাৎ লোককে দেখানোর জন্য নামাজ আদায় করিয়া থাকে। কোন এক কবি এ সম্বন্ধে বলিয়াছেন,

‘জাবা দর জেকরে ওয়া দেল দর ফেকরে খানা,
চে হাসেল শোদ জী নামাজে পাঞ্জে গানা।
চে শোদ গার মসহা-ফাহ দর পেশে বাশোদ,
চু দেল দর ফেকের গাওউ মেশে বাশোদ’।

অর্থ: মুখে আল্লাহর জিকির ও হৃদয়ে বাড়ি-ঘরের চিন্তা থাকিলে, সেই প্রকার পাঞ্জেগানা নামাজে তোমার কী লাভ হইবে? তোমার মনে যদি গরু ও মেষের ভাবনা বা চিন্তা থাকে, তবে সম্মুখে কোরআন খুলিয়া রাখিলে কি ফল হইবে? অতএব, খোদার ইবাদতে ঘোড়া, গরু, ভেড়া, বকরি, স্ত্রী-পুত্রকে গায়রুল্লাহ্ ভাবিয়া আমরা বাতেনে মোশরেক হইতেছি। ইহা কত বড় ভয়ঙ্কর পাপের কাজ করিতেছি! এসকল শিরক হইতে মুক্তির ব্যবস্থা করা কি আমাদের কর্তব্য নহে? হযরত রাসুলপাক (সঃ) ফরমাইয়াছেন, ‘এমন অনেক নামাজী আছে, তাহাদের পরিশ্রম ও ক্লান্তি ব্যতীত নামাজ হইতে আর কিছুই লাভ হয় না। ইহার কারণ এই যে, তাহারা কেবল শরীরকে কষ্ট দিয়া এবং ক্লান্ত করিয়া নামাজ পড়িয়া থাকে। অথচ তাহাদের অন্তর আল্লাহতায়ালা হইতে বহু দূরে থাকে। হযরত হাসান বস্রী (রহ:) বলিয়াছেনÑ ‘যে নামাজ একাগ্রচিত্তের সহিত না হয়, সে নামাজ শাস্তির যোগ্য। অর্থাৎ যে নামাজী নামাজকে একাগ্রচিত্ততার সহিত পড়িবার জন্য চেষ্টাও করে না, কিংবা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়িয়া থাকে, তাহার নামাজ শাস্তিযোগ্য। অন্য আর এক হাদিসে আছে, যে নামাজী স্বীয় নামাজকে বাজে কল্পনা ও নানাবিধ চিন্তা হইতে মুক্ত রাখিতে চেষ্ট করে না (অর্থাৎ বাজে চিন্তা হইতে মুক্ত রাখিতে চেষ্টা করে না) সে আল্লাহতায়ালার দরবার হইতে বিতাড়িত হওয়া ব্যতীত উক্ত নামাজে কোন ফল পাইবে না। এখন বোধ হয়, জাহেরা আলেমগণ হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সাহেবের দায় দিয়া অব্যাহতি পাইতে চেষ্টা করিবেন।

হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সাহেব যে রায় দিয়াছেন, নামাজের প্রথম তাকবিরের সময় আল্লাহতায়ালার স¦রণ হইলেই নামাজ হইয়া যাইবে। ইহার অর্থ এই নয় যে, নামাজের অন্য অংশে আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করিতে হইবে না। বরং উহার মর্মে এই বোঝা যায় যে, নামাজের সকল অংশেই আল্লাহকে স্মরণ রাখিতে হইবে। কিন্তু কেহ যদি কোন ওযরবশত: উহাতে অক্ষম হয়, তবে প্রথম তকবিরে খোদাতায়ালাকে স্মরণ করিলেও তাহার নামাজ কোন রকমে আদায় হইয়া যাইবে। ইহা তিনি নাচারী অবস্থায় মত দিয়াছেন। তাই বলিয়া তিনি ইহা বলেন নাই, তোমরা জীবনভরই ওইভাবে নামাজ পড়িও। অথচ তিনি ইহাও বলিয়াছেন যে, কোরআন ও হাদিসের বিরুদ্ধে যদি তোমরা আমার কোন কথা দেখিতে পাও, তবে উহা বাদ দিয়া কোরআন ও হাদিসমতে আমল করিও। অনেক লোক আছে, তাহারা নিজে নিজে নামাজে হুজুরীর জন্য খুব চেষ্ট করিয়া থাকে, কিন্তু কোন কামেল অলির সাহায্য নেয় না। তাহারা বলে, নামাজে হুজুরী দিলের জন্য চেষ্টা করার হুকুম আছে। আমরা হুজুরীর জন্য চেষ্টা করিয়া থাকি, তাহা সত্বেও যদি হুজুরী দিল না হয়, তবে আমরা আল্লাহর হুজুরে দায়ী হইবো না। নিশ্চয় তাহারা হুজুরীর জন্য দায়ী হইবে। কেননা, আল্লাহতায়ালা মানুষকে পাপের সাগর হইতে মুক্ত করার জন্য সবসময় সব দেশে অলি পাঠাইয়া আসিতেছেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সঃ) অলিদের নিকট গিয়া মানুষের আমলকে শুদ্ধ করার জন্য আদেশ করিয়াছেন। সেই অলিদের সাহায্য না নিয়া, এখন যদি নিজে নিজে শত চেষ্টাও করা হয়, তবে সেই চেষ্টার কোন মূল্য নাই। দুনিয়ার তুলনায় আখেরাতের কাজ অতি কঠিন ও আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া অতি তুচ্ছ ও মূল্যহীন। সেই কাজের জন্য অন্যের সাহায্য নিতে এতো আপত্তি কেন? ইহা শয়তানের ধোকা ভিন্ন আর কিছু নহে। ইহা তাহাদের ঈমানের কমজোরী এবং তাহাদের ভিতরে আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)-এর মহব্বত ও ভয় না থাকার নিদর্শন।

এখন জানা আবশ্যক যে, এমন কি কোন হাদিস বা কোরআনের বাণী আছে যে, প্রথম তকবীরের সময় হুজুরীদিল হইলেই নামাজ শুদ্ধ হইয়া যাইবে? বরং নামাজের প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত হুজুরী দিলে নামাজ পড়া সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে বহু আয়াত ও হাদিস রহিয়াছে। নামাজের মধ্যে অন্ত:করণকে (দিলকে) হাজির রাখিয়া ভীতি ও ভক্তি সহকারে প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালাকে হাজির-নাজির জানিয়া, তাহার ধ্যান ও নামে বিভোর হইয়া, নামাজ পড়াকে নামাজের প্রাণ বলা হয়। এই মর্মেই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কালামে সূরা ত্বোয়া’র প্রথম রুকুতে ফরমাইয়াছেনÑ ‘ওয়া আক্বিমুস্বস্বালা-তা লিয্কিরী’। (আয়াত নং ১৪)। অর্থ : আমাকে (আল্লাহকে) স্মরণ করার জন্য নামাজ কায়েম কর। ইহা দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সমগ্র নামাজেই আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করিতে হইবে এবং তাহার স্মরণ ও ধ্যানই নামাজের আসল উদ্দেশ্য। তাই রাসুল করিম (সঃ) ফরামাইয়াছেনÑ ‘আন তা‘য়াবু-দাল্লাহা কা আন্নাকা তারাহু ফাইন্ লাম তাকুন্ তারাহু ফাইন্নাহু ইয়ারাক’। অর্থ : তুমি এমনভাবে আল্লাহতায়ালার বন্দেগী কর, যেন তুমি আল্লাহকে দেখিতেছ। যদি উহা না পার, তবে এইরূপভাবে আল্লাহর ইবাদত কর, যেন আল্লাহ তোমাকে দেখিতেছেন। এই হাদিস দ্বারা ইহাই প্রমাণ হইতেছে যে, সমস্ত নামাজেই আল্লাহাতায়ালার মোশাহেদা (দর্শন) লাভ করিতে হইবে। যদি উহাতে অক্ষম হয়, তবে কমপক্ষে আল্লাহ দেখিতেছেন, এই খেয়ালে সমস্ত নামাজ আদায় করা আবশ্যক। ইহার ব্যতিক্রম হইলে নামাজ শুদ্ধ হইবে না। অন্য আর এক হাদিসে আছে যে, রসুল করিম (সঃ) ফরমাইয়াছেনÑ ‘আচ্ছালাতু মিরাজুল মো‘মিনিন’। অর্থ: নামাজ মোমিনদের জন্য মেরাজ’। অর্থাৎ, খোদাপ্রাপ্তির সোপান।

আমি এখন তরিকতের বিদ্বেষী এবং শুধু শরিয়ত অবলম্বী আলেম ও মুসল্লিগণকে জিজ্ঞাসা করি, নামাজে আপনাদের মেরাজ কয়দিন হইয়াছে? এতকাল নামাজ পড়িয়া যদি কোন দিন মেরাজ না হইয়া থাকে, তবে রাসুলুল্লাহ (সঃ) কি অসত্য বলিয়াছেন? (নাউযুবিল্লাহ), তিনি সত্যই বলিয়াছেন। কেবল আমাদের নিজের শৈথিল্যে নামাজকে মেরাজ করিয়া তুলিতে পারি না। ইহা করা অসম্ভব নহে, কামেল-মোকাম্মেল মুর্শিদের তাওয়াজ্জুহ্ গ্রহণ করিয়া, কঠোর সাধনা ও চেষ্টা করিলেই তাহা সম্ভব হইবে। যদি অসম্ভব হইত তাহা হইলে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এই কথা বলিতেন না। হযরত আনাছ (রা:) হইতে অন্য এক হাদিসে রেওয়ায়েত আছেÑ যথা : ‘ইন্নামাল মু‘মিনুনাইয়া কানা ফিছ্ছালাতি ফাইন্নামা ইয়ুনাজি রাব্বাহু’। অর্থ: নিশ্চয় মোমিন ব্যক্তি নামাজের মধ্যে তাহার পালনকর্তার সহিত কথোপকথন করিয়া থাকে। প্রিয় সম্মানিত পাঠকগণ, এ পর্যন্ত কোরআন ও হাদিসের যে সমস্ত বাণী উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাতে চিন্তা করিয়া দেখুন যে, পুরুষ ও মেয়েলোক উভয়ের জন্যই হুজুরী দিলে নামাজ পড়া ফরজ কিনা? কেহ যদি নিজে নিজে চেষ্টা করিয়া হুজুরীদিল ঠিক করিতে না পারে, তবে যে ব্যক্তি হুজুরীদিল ঠিক করিয়া দিতে পারেন, তাহার নিকট গিয়া হুজুরী দিলে নামাজ পড়ার জন্য চেষ্টা করা ফরজ কি না? জ্ঞানীমাত্রই একথা স্বীকার করিবেন যে, হুজুরী দিলে নামাজ পড়া ফরজ এবং হুজুরী দিলে নামাজ পড়ার জন্য কামেল মোকাম্মেল মুর্শিদের তাওয়াজ্জুহ গ্রহণ করিয়া চেষ্টা করাও ফরজ।

দায়েমী সালাত প্রসঙ্গে

দায়েমী সালাত

আত্মদর্শন উদ্দেশ্য শেরেক হইতে মুক্ত হইবার জন্য দায়েমি সালাত পালনের আহ্বান।সালাত বলিতেই দায়েমি সালাত বুঝায়। আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রসুলের সঙ্গে সংযোগ প্রচেষ্টার নাম সালাত। রসুলের সংযোগই আল্লাহ্‌র সংযোগ। এই সংযোগ অর্থাৎ সালাত যে ব্যক্তি পালন করে তাহাকে মুসল্লি বলে। মুসল্লির পরিচয় দিতে যাইয়া কোরানে বলা হইয়াছে সেই ব্যক্তি মুসল্লি, যে ব্যক্তি দায়েমি সালাত পালন করে (মুসল্লির সংজ্ঞা ও তাঁর পরিচয় দ্রষ্টব্য ৭০:২২-৩০,৩২-৩৫). ইহাও একটি কারণ যাহার জন্য কোরানে পাঁচ বা ছয়বারের ওয়াক্তিয়া সালাতের উল্লেখ নাই। কোরান মূলনীতি প্রকাশক। খণ্ড খণ্ড পাঁচবেলার নামাজ কোরানে অগ্রাহ্য। একটানা দায়েমি সালাতের নির্দেশ দান করা কোরানের লক্ষ্য।

কর্মই সালাতের উপদান। এই কারণে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলিয়াছেনঃ “সম্যক কর্ম সম্যক সময়ে যথাবিহিত সম্পাদনের নাম সালাত।” সকল কর্ম ও চিন্তাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে তাহার স্বরূপকে জ্ঞান দ্বারা বিস্তারিত দেখিবার নাম সালাত। কর্মকে যতই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করিয়া দেখা যায় ততই সালাতের গভীরতা আসে।

 আনুষ্ঠানিক ওয়াক্তিয়া সালাত হইল গুণ-কীর্তন, আর দায়েমি সালাত হইল জ্ঞানগুণ অর্জন। 

 সালাতের মূলনীতিকে জীবনে রূপায়িত করার ব্যবস্থা হিসাবে আনুষ্ঠানিক পাঁচবেলার বাধ্যতামূলক এবং ভোররাত্রের একবেলা তাগিদমূলক সালাত পালনের ব্যবস্থা রসুলুল্লাহ (আ.) দান করিয়া গিয়াছেন, যেন মানুষ তাহার সারাদিনের কর্মগুলিকে আল্লাহ্‌র এবাদতে রূপান্তরিত করিয়া তুলিতে পারে। মুসল্লি হওয়ার জন্য কোরান মজিদের দায়েমি সালাতের নির্দেশ দিতেছেন। কাজেই ধর্মীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত না হইলে সরকারী কর্মচারীগণ দায়েমি সালাত পালন করিয়া মুসল্লি হইতে পারিবেন না। ইহার কারণ যে সময়টুকু তাহারা সরকারের কাজে লিপ্ত থাকিবে সেই সময়টুকু সালাতরূপে গণ্য হবে না। এবং তাহা আল্লাহ্‌র এবাদতরূপে গণ্য হয় না যতকাল সমগ্র কর্ম এবাদতরূপে গৃহীত না হয় ততকাল মুসল্লিরূপে এবং সৎকর্মশীল দাসরূপে আল্লাহ্‌ গ্রহণ করেন না।

এই জীব ও জড় জগতের উদ্ভাবনের মূল কারণই হইল মানুষ নামক জীবকে জীবের ঊর্ধ্বে করিয়া আল্লাহ্‌র শক্তিশালী স্তরের সহিত মিলাইয়া লওয়া। মানুষের মধ্যে দুইটি স্তর, যথাঃ জ্বীন ও ইনসান। পশু প্রবৃত্তির ইন্দ্রিয়পরায়ণ মানুষ হইল জ্বীন পর্যায়ের। আর মোমিনের নিকট সমর্পণকারী ও মোমিনদের অনুসরণকারী মানুষ হইল ইনসান পর্যায়ের। এই উভয় প্রকার মানুষকে মোমিনগণ সালাত শিক্ষা দানের মাধ্যমে অবতার পর্যায়ে উন্নীতকরণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এই কার্য সমাধা করিবার জন্যই একটি ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র বানাইয়া লওয়ার প্রয়োজন, যাহাতে সালাতের শিক্ষা নির্বিঘ্নে দান করা যায়। নতুবা দুনিয়াদার মানুষ মমিনগনকে এবং তাঁহাদের অনুসারীগণকে আক্রমণ করিয়া মারিয়া ফেলে অথবা তাঁহাদের সালাত অনুশীলন কার্যক্রমকে কঠিন ও কষ্টসাধ্য করিয়া তুলে। তাই ইসলামী রাষ্ট্রে গঠনের মূল লক্ষ্যই হইল সালাত শিক্ষা দান করা। সালাত কর্ম যতক্ষণ দায়েমী না হয় ততক্ষণ একজন সাধকের মুক্তি আসে না।শুরুর পর্যায়ে সালাতকে দায়েমী করিবার জন্য একজন মানুষকে তাহার দৈনন্দিন বৈষয়িক কাজকর্ম বন্ধ রাখিয়া একজন মোমিন গুরুর নির্দেশমত ঘরে এবং মসজিদে বসিয়া সালাত প্রশিক্ষণ লইতে হয়। এই জন্যই নবী-রসুলগণ প্রতি সাতদিনের যেকোন একটি দিনকেই তাই সপ্তম দিবস হিসেবে গ্রহণ করা যাইতে পারে। রাষ্ট্রের সবাই এই নির্দিষ্ট দিনে নিজ নিজ মোমিন গুরুর নির্দেশমত সালাত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করিলে সামাজিক কার্যক্রম অচল হইয়া যাইতে পারে, তাই কিছু লোক দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যাইবে এবং তাহাদের জন্য সপ্তাহের অন্য কোন একটি দিন বৈষয়িক কাজকর্ম হইতে অব্যাহতি দিয়া দায়েমী সালাতের ব্যবস্থা করিতে হইবে।এইভাবে সপ্তাহের একটি দিনে যখন একটি মানুষ নিরবচ্ছিন্ন সালাত প্রশিক্ষণে আগাইয়া যায়, তখন ধীরে ধীরে ২৪ ঘণ্টার একটি দিনের পুরো ২৪ ঘণ্টাই সে নিরবচ্ছিন্নভাবে সালাতী হালে থাকিতে অভ্যস্ত হইয়া যায়। ইহা সম্পন্ন হইলে সপ্তাহের অন্য ছয়টি দিনেও তাহার এই সালাতি হাল বিস্তার লাভ করে।এই পর্যায়ে তাহাকে আর বৈষয়িক কার্যক্রম হইতে বিরত হইবার প্রয়োজন হয় না; বরং তাহার উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, লেনদেন, ঘুম-জাগরণ ইত্যাদি সমস্ত কাজেই সালাত ক্রিয়া বিস্তার লাভ করিতে থাকে। এইভাবে একজন মানুষের জীবনে দায়েমী সালাত প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

গুরুকেন্দ্রিক সালাতের আত্মিক অনুশীলনের কথা কোরানে সর্বত্র পরিব্যক্ত আছে। সালাত প্রক্রিয়ার সাহায্যে জন্মান্তরবাদের পরিচয় জ্ঞান পরিস্ফুট হইয়া উঠে এবং বিষয়-দর্শনের উপর জ্ঞানচক্ষু উদিত হয় বা উন্মীলিত হয়। এই সকল কথা কোরানে সর্বত্র থাকা সত্ত্বেও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিলে কোরানের কোন দর্শন উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বস্তুবাদী অর্থের মধ্যে অসংখ্য আত্মবিরোধী ভাব এবং গরমিল বিদ্যমান।

*লা-মোকায় উত্তোরণের জন্য তথা মুক্তিকামী সাধকদের জন্য বা খাস করিয়া ইনসানের জন্য জ্ঞানীবাদী সালাত যথাযোগ্য। এবং ইনসান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বা রহমান রূপী সম্যক গুরুর নিকট হইতে কোরানজ্ঞান বা গুরুজ্ঞান অর্জন পর্যন্ত গুরুবাদী সালাত বা ভক্তিবাদী সালাতই যথার্থ।

*চক্ষু : ইহা দ্বারা আল্লাহর দাসগণ পান করেন : তাহারা ইহা সঞ্চালিত করেন এক একটি সঞ্চালন।  তাহারা দৃষ্টি দ্বারা অর্জন করেন পরিপূর্ণতা এবং ভয় করেন সেই সময়টিকে যাহার মন্দ ব্যাপক (বা বিস্তৃত) হইয়া থাকে। (৭৬:৬+৭) 

ব্যাখ্যা(৬+৭)- আপন মুর্শেদের চেহারা মোবারকের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া তাঁহা হইতে আপন চক্ষু দ্বারা প্রেম শরাব পান করিবার রীতি অনেক তরিকার মধ্যে ব্যবস্থা হিসাবে প্রচলিত আছে। অবশ্য নিছক বস্তুবাদী তরিকার মধ্যে ইহা থাকিবে না। তাহারা ইহাকে শেরেক বলিয়াই মনে করে।

আল্লাহর দাসগণ চক্ষু দ্বারা পান করিয়া পূণ্যবান হইয়া থাকেন। তাহারা পান করেন আপন কামেল মুর্শেদের চেহারার অমৃত সুধা। মুর্শেদের চেহারা ধ্যান করা আল্লাহর দাসত্বের প্রধান অঙ্গ। এই আমল দ্বারা যাহারা পূণ্যবান হইয়াছেন তাহারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এক এক করিয়া আগমনকারী প্রত্যেকটি বিষয়ের উপরে। ইহাতে মোহকালিমা হইতে সকল বিষয় পরিশুদ্ধ হইয়া সৌন্দর্যমণ্ডিত হইয়া উঠে। বিষয়ের বিষমুক্ত হইয়া সকলই সুন্দরমধুময় হইয়া যায়।

এইরূপে তাহার দৃষ্টি দ্বারা অর্জন করেন জীবনের পরিপূর্ণতা। তাহারা ভয় করেন সেই সময়ের মন্দকে যাহা সংসার জীবনে সাধারণত ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করিতেছে। মানুষ জন্মলগ্ন হইতে সালাত কর্ম শুরু না করা পর্যন্ত সময়কে মন্দ সময় বলিয়া আখ্যায়িত করা হইয়াছে। কারণ, মানুষ এই সময় সালাতের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে এবং বিষয় মোহের শিরিক দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে বিধায় সে পরিপূর্ণভাবে একজন মোশরেক এবং কাফের। সালাত কর্ম আরম্ভ না করা পর্যন্ত সময়ের মন্দ স্বরূপটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি করিতেই থাকে। এই কারণে সাধকগণ এই মন্দ সময়টিকে ভয় পান এইজন্য যে, পরজীবনে জ্ঞানী গুরুর সংস্পর্শে আসিবার সম্ভাবনা নাও থাকিতে পারে। কারণ, অর্জিত বিষয়মোহ এবং কুফুরী ক্রমবর্ধমান হইয়া মানুষের মন ও মস্তিষ্ককে গ্রাস করিয়া ফেলে।

*নিশ্চয় ইহাই তোমাদের জন্য চিরস্থায়ী প্রতিদান এবং তোমাদিগের কর্মপ্রচেষ্টা ধন্যবাদ প্রাপ্ত।(৭৬:২২) 

ব্যাখ্যাঃ সালাত কর্মের প্রয়োগ দ্বারা সাধকের ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি দ্বারপথে আগমনকারী বিষয়রাশি পবিত্র হইয়া যায় ----ইহাই চিরস্থায়ী প্রতিদান অর্থাৎ চিরস্থায়ী অর্জন; তখনই কেবল রব হইতে ধন্যবাদ প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জিত হয়।