দায়েমী সালাত
আত্মদর্শন উদ্দেশ্য শেরেক হইতে মুক্ত হইবার জন্য দায়েমি সালাত পালনের আহ্বান।সালাত বলিতেই দায়েমি সালাত বুঝায়। আল্লাহ্ ও তাঁহার রসুলের সঙ্গে সংযোগ প্রচেষ্টার নাম সালাত। রসুলের সংযোগই আল্লাহ্র সংযোগ। এই সংযোগ অর্থাৎ সালাত যে ব্যক্তি পালন করে তাহাকে মুসল্লি বলে। মুসল্লির পরিচয় দিতে যাইয়া কোরানে বলা হইয়াছে সেই ব্যক্তি মুসল্লি, যে ব্যক্তি দায়েমি সালাত পালন করে (মুসল্লির সংজ্ঞা ও তাঁর পরিচয় দ্রষ্টব্য ৭০:২২-৩০,৩২-৩৫). ইহাও একটি কারণ যাহার জন্য কোরানে পাঁচ বা ছয়বারের ওয়াক্তিয়া সালাতের উল্লেখ নাই। কোরান মূলনীতি প্রকাশক। খণ্ড খণ্ড পাঁচবেলার নামাজ কোরানে অগ্রাহ্য। একটানা দায়েমি সালাতের নির্দেশ দান করা কোরানের লক্ষ্য।
কর্মই সালাতের উপদান। এই কারণে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলিয়াছেনঃ “সম্যক কর্ম সম্যক সময়ে যথাবিহিত সম্পাদনের নাম সালাত।” সকল কর্ম ও চিন্তাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে তাহার স্বরূপকে জ্ঞান দ্বারা বিস্তারিত দেখিবার নাম সালাত। কর্মকে যতই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করিয়া দেখা যায় ততই সালাতের গভীরতা আসে।
আনুষ্ঠানিক ওয়াক্তিয়া সালাত হইল গুণ-কীর্তন, আর দায়েমি সালাত হইল জ্ঞানগুণ অর্জন।
সালাতের মূলনীতিকে জীবনে রূপায়িত করার ব্যবস্থা হিসাবে আনুষ্ঠানিক পাঁচবেলার বাধ্যতামূলক এবং ভোররাত্রের একবেলা তাগিদমূলক সালাত পালনের ব্যবস্থা রসুলুল্লাহ (আ.) দান করিয়া গিয়াছেন, যেন মানুষ তাহার সারাদিনের কর্মগুলিকে আল্লাহ্র এবাদতে রূপান্তরিত করিয়া তুলিতে পারে। মুসল্লি হওয়ার জন্য কোরান মজিদের দায়েমি সালাতের নির্দেশ দিতেছেন। কাজেই ধর্মীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত না হইলে সরকারী কর্মচারীগণ দায়েমি সালাত পালন করিয়া মুসল্লি হইতে পারিবেন না। ইহার কারণ যে সময়টুকু তাহারা সরকারের কাজে লিপ্ত থাকিবে সেই সময়টুকু সালাতরূপে গণ্য হবে না। এবং তাহা আল্লাহ্র এবাদতরূপে গণ্য হয় না যতকাল সমগ্র কর্ম এবাদতরূপে গৃহীত না হয় ততকাল মুসল্লিরূপে এবং সৎকর্মশীল দাসরূপে আল্লাহ্ গ্রহণ করেন না।
এই জীব ও জড় জগতের উদ্ভাবনের মূল কারণই হইল মানুষ নামক জীবকে জীবের ঊর্ধ্বে করিয়া আল্লাহ্র শক্তিশালী স্তরের সহিত মিলাইয়া লওয়া। মানুষের মধ্যে দুইটি স্তর, যথাঃ জ্বীন ও ইনসান। পশু প্রবৃত্তির ইন্দ্রিয়পরায়ণ মানুষ হইল জ্বীন পর্যায়ের। আর মোমিনের নিকট সমর্পণকারী ও মোমিনদের অনুসরণকারী মানুষ হইল ইনসান পর্যায়ের। এই উভয় প্রকার মানুষকে মোমিনগণ সালাত শিক্ষা দানের মাধ্যমে অবতার পর্যায়ে উন্নীতকরণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এই কার্য সমাধা করিবার জন্যই একটি ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র বানাইয়া লওয়ার প্রয়োজন, যাহাতে সালাতের শিক্ষা নির্বিঘ্নে দান করা যায়। নতুবা দুনিয়াদার মানুষ মমিনগনকে এবং তাঁহাদের অনুসারীগণকে আক্রমণ করিয়া মারিয়া ফেলে অথবা তাঁহাদের সালাত অনুশীলন কার্যক্রমকে কঠিন ও কষ্টসাধ্য করিয়া তুলে। তাই ইসলামী রাষ্ট্রে গঠনের মূল লক্ষ্যই হইল সালাত শিক্ষা দান করা। সালাত কর্ম যতক্ষণ দায়েমী না হয় ততক্ষণ একজন সাধকের মুক্তি আসে না।শুরুর পর্যায়ে সালাতকে দায়েমী করিবার জন্য একজন মানুষকে তাহার দৈনন্দিন বৈষয়িক কাজকর্ম বন্ধ রাখিয়া একজন মোমিন গুরুর নির্দেশমত ঘরে এবং মসজিদে বসিয়া সালাত প্রশিক্ষণ লইতে হয়। এই জন্যই নবী-রসুলগণ প্রতি সাতদিনের যেকোন একটি দিনকেই তাই সপ্তম দিবস হিসেবে গ্রহণ করা যাইতে পারে। রাষ্ট্রের সবাই এই নির্দিষ্ট দিনে নিজ নিজ মোমিন গুরুর নির্দেশমত সালাত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করিলে সামাজিক কার্যক্রম অচল হইয়া যাইতে পারে, তাই কিছু লোক দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যাইবে এবং তাহাদের জন্য সপ্তাহের অন্য কোন একটি দিন বৈষয়িক কাজকর্ম হইতে অব্যাহতি দিয়া দায়েমী সালাতের ব্যবস্থা করিতে হইবে।এইভাবে সপ্তাহের একটি দিনে যখন একটি মানুষ নিরবচ্ছিন্ন সালাত প্রশিক্ষণে আগাইয়া যায়, তখন ধীরে ধীরে ২৪ ঘণ্টার একটি দিনের পুরো ২৪ ঘণ্টাই সে নিরবচ্ছিন্নভাবে সালাতী হালে থাকিতে অভ্যস্ত হইয়া যায়। ইহা সম্পন্ন হইলে সপ্তাহের অন্য ছয়টি দিনেও তাহার এই সালাতি হাল বিস্তার লাভ করে।এই পর্যায়ে তাহাকে আর বৈষয়িক কার্যক্রম হইতে বিরত হইবার প্রয়োজন হয় না; বরং তাহার উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, লেনদেন, ঘুম-জাগরণ ইত্যাদি সমস্ত কাজেই সালাত ক্রিয়া বিস্তার লাভ করিতে থাকে। এইভাবে একজন মানুষের জীবনে দায়েমী সালাত প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
গুরুকেন্দ্রিক সালাতের আত্মিক অনুশীলনের কথা কোরানে সর্বত্র পরিব্যক্ত আছে। সালাত প্রক্রিয়ার সাহায্যে জন্মান্তরবাদের পরিচয় জ্ঞান পরিস্ফুট হইয়া উঠে এবং বিষয়-দর্শনের উপর জ্ঞানচক্ষু উদিত হয় বা উন্মীলিত হয়। এই সকল কথা কোরানে সর্বত্র থাকা সত্ত্বেও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিলে কোরানের কোন দর্শন উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বস্তুবাদী অর্থের মধ্যে অসংখ্য আত্মবিরোধী ভাব এবং গরমিল বিদ্যমান।
*লা-মোকায় উত্তোরণের জন্য তথা মুক্তিকামী সাধকদের জন্য বা খাস করিয়া ইনসানের জন্য জ্ঞানীবাদী সালাত যথাযোগ্য। এবং ইনসান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বা রহমান রূপী সম্যক গুরুর নিকট হইতে কোরানজ্ঞান বা গুরুজ্ঞান অর্জন পর্যন্ত গুরুবাদী সালাত বা ভক্তিবাদী সালাতই যথার্থ।
*চক্ষু : ইহা দ্বারা আল্লাহর দাসগণ পান করেন : তাহারা ইহা সঞ্চালিত করেন এক একটি সঞ্চালন। তাহারা দৃষ্টি দ্বারা অর্জন করেন পরিপূর্ণতা এবং ভয় করেন সেই সময়টিকে যাহার মন্দ ব্যাপক (বা বিস্তৃত) হইয়া থাকে। (৭৬:৬+৭)
ব্যাখ্যা(৬+৭)- আপন মুর্শেদের চেহারা মোবারকের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া তাঁহা হইতে আপন চক্ষু দ্বারা প্রেম শরাব পান করিবার রীতি অনেক তরিকার মধ্যে ব্যবস্থা হিসাবে প্রচলিত আছে। অবশ্য নিছক বস্তুবাদী তরিকার মধ্যে ইহা থাকিবে না। তাহারা ইহাকে শেরেক বলিয়াই মনে করে।
আল্লাহর দাসগণ চক্ষু দ্বারা পান করিয়া পূণ্যবান হইয়া থাকেন। তাহারা পান করেন আপন কামেল মুর্শেদের চেহারার অমৃত সুধা। মুর্শেদের চেহারা ধ্যান করা আল্লাহর দাসত্বের প্রধান অঙ্গ। এই আমল দ্বারা যাহারা পূণ্যবান হইয়াছেন তাহারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এক এক করিয়া আগমনকারী প্রত্যেকটি বিষয়ের উপরে। ইহাতে মোহকালিমা হইতে সকল বিষয় পরিশুদ্ধ হইয়া সৌন্দর্যমণ্ডিত হইয়া উঠে। বিষয়ের বিষমুক্ত হইয়া সকলই সুন্দরমধুময় হইয়া যায়।
এইরূপে তাহার দৃষ্টি দ্বারা অর্জন করেন জীবনের পরিপূর্ণতা। তাহারা ভয় করেন সেই সময়ের মন্দকে যাহা সংসার জীবনে সাধারণত ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করিতেছে। মানুষ জন্মলগ্ন হইতে সালাত কর্ম শুরু না করা পর্যন্ত সময়কে মন্দ সময় বলিয়া আখ্যায়িত করা হইয়াছে। কারণ, মানুষ এই সময় সালাতের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে এবং বিষয় মোহের শিরিক দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে বিধায় সে পরিপূর্ণভাবে একজন মোশরেক এবং কাফের। সালাত কর্ম আরম্ভ না করা পর্যন্ত সময়ের মন্দ স্বরূপটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি করিতেই থাকে। এই কারণে সাধকগণ এই মন্দ সময়টিকে ভয় পান এইজন্য যে, পরজীবনে জ্ঞানী গুরুর সংস্পর্শে আসিবার সম্ভাবনা নাও থাকিতে পারে। কারণ, অর্জিত বিষয়মোহ এবং কুফুরী ক্রমবর্ধমান হইয়া মানুষের মন ও মস্তিষ্ককে গ্রাস করিয়া ফেলে।
*নিশ্চয় ইহাই তোমাদের জন্য চিরস্থায়ী প্রতিদান এবং তোমাদিগের কর্মপ্রচেষ্টা ধন্যবাদ প্রাপ্ত।(৭৬:২২)
ব্যাখ্যাঃ সালাত কর্মের প্রয়োগ দ্বারা সাধকের ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি দ্বারপথে আগমনকারী বিষয়রাশি পবিত্র হইয়া যায় ----ইহাই চিরস্থায়ী প্রতিদান অর্থাৎ চিরস্থায়ী অর্জন; তখনই কেবল রব হইতে ধন্যবাদ প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জিত হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন