👉''আমি'' দর্শনে কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে?"
✍️এই দেহের বাহিরের রুপ দেখে মানুষ মানুষের প্রেমে পড়ে, পাগল হয়, একজন আরেকজন কে পাওয়ার জন্য আত্ম হত্যা পর্যন্ত করে, আবার কেউ কাম রিপুতে জ্বলে উঠে কিন্তু কেউ যদি একবার দেহের ভিতরের রুপ দেখতে পারতো তাহলে সে হয়তো সারাজীবন তাকে পাবার জন্য তার দাসত্ব করত। ঐ রুপের সাথে বুকে বুক মিশিয়ে আলিঙ্গন করার জন্য আহার নিদ্রা ত্যাগ করে এক নিরিখে বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতো। অপার সৌন্দর্যময় সেই রুপের পাগলে সে হয়ে যেত 'পাগল'। কারণ আত্মা এক জ্বলন্ত নূরের প্রদীপ। যার আলোতে আলোকিত এই 'মানব দেহ'।
আসলে মানুষ ৬০-৭০-৮০ বছর একটা পরিবারে ক্ষনিকের জন্য আসে, তারপর অনেক মায়া মহব্বত রেখে সবাই কে কাঁদিয়ে একদিন হঠাৎ করে চলে যায়। আর ফিরে আসে না। যে চলে গেল তাকে ঐ পরিবারের কয়জন চিনতে পেরেছে?
যেমন- স্বামী-স্ত্রী বাসর রাত হতে সারা জীবন এক খাটে এক বিছানায় শুয়ে কত কথা, কত ব্যাথা, হাসি খুশি আলাপন করে সাংসারিক জীবন অতিবাহিত করে দিল কিন্তু তারা কি আদৌ স্বামী স্ত্রী ছিল নাকি শুধু দেহের সাথে বসবাসের পরিচয় ছিল। সে হিসেবে মূল তত্ত্বে স্বামী-স্ত্রী খুজে পাওয়া বিরল হবে। কারণ উভয়ের আত্মদর্শন না হলে তাদের কে স্বামী স্ত্রী বলা আর পরগাছা কে গাছ বলা সমান কথা। দেহের মধ্যে কোনটুক স্বামী আর কোনটুক স্ত্রী তা স্বচক্ষে না দেখলে কেউ বলতে পারবে না কার সাথে কে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।
স্বামী = স্ব+আমি
= আমি+আমি
= আমি। জিব্রাইল নামক ফেরেশতাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। অথচ আমরা সবাই জানি যে জিব্রাইল ফেরেশতা যতই মর্যাদার অধিকারী হন না কেন, কিন্তু জিব্রাইল ফেরেশতার মাঝে রূহ্ও নাই এবং নফ্সও নাই। একমাত্র চৈতন্য আত্মার বা রুহের আজ্ঞাবহ বা রুহের বার্তা বাহক হয়ে সে তাহার হুকুম পালন করে থাকেন।
আল্লাহ যদি পূর্বেই সমস্ত রুহ কে সৃষ্টি করে থাকেন অর্থাৎ সব আত্মাই যদি পুরাতন হয়ে থাকে তাহলে এটা নিশ্চিত বলা যায় যে, সকল রুহ বা আত্মা পূর্ব হতেই সকল সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে অবগত রয়েছে। অর্থাৎ সকল আত্মাই জ্ঞানী। যে দেহের মধ্যে রুহ বা আত্মা নেই সে দেহের রহস্য শুন্য, তার মূল্যও শুন্য। আবার সকল আত্মাই যদি "জ্ঞানী" হয় তাহলে সকল শিশু বাচ্চা কেন অবুঝের মত চলাফেরা করে? কেন অজ্ঞানী হয়?
কারণ আত্মা নিজেকে প্রকাশ করতে গিয়ে দেহের মধ্যে নিজেকে আত্ম গোপন করে কিন্তু জ্ঞানী হয়েও দেহের ষড় রিপুর মায়াবী জালে সে প্রতিবন্দী হয়ে যায়। তখন সে মাতাল হয়ে ঘুমের ন্যায় শিকলে আটকা পড়ে আর বলে কেন এলাম এমন ভয়ানক কলকাঠির ঘরে? আমাকে মুক্ত কর এ বেড়াজাল থেকে ! বলতে বলতে মায়ার জালে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। একারণে শিশু বাচ্চা ঘুমের ঘরে কখনও কেঁদে উঠে আবার কখনও হেসে উঠে এবং ঘুম ভাঙ্গলে জ্ঞান বিবেক হারিয়ে ফেলে। এই মহাবিশ্বের সঙ্গে বিশ্ব নবুয়াতের এক বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। সেই সুনিবীড় সম্পর্কও আমাদের আত্মা চেতন করে জানতে হবে। তাহলে মহাবিশ্ব এবং বিশ্ব নবুয়তের সঙ্গে মহান স্রষ্টার কি সম্পর্ক তা আমরা জানতে ও বুঝতে পারবো।
সর্বোপরি জীবনের বহু উপরে জীবন্ত কোরআনের সঙ্গে মহাবিশ্ব এবং মহান স্রষ্টার কি সুমধুর সম্পর্ক রয়েছে সে বিষয়ে আমাদের মনের সকল অজ্ঞতা ও অন্ধকার কেটে যাবে।
বাহ্যিক চক্ষু দিয়ে দেখে আমরা মনে করি, আগুন, পানি, মাটি, বাতাসের সমন্বয়ে এই পৃথিবীর এত বিচিত্র বন-বনানী, ফুল, ফল, পাখি, সাগর, নদী, ঝর্ণা, পাহাড়, মরুর অগণিত বালুকারাশি, বিচিত্র জীবগোষ্ঠী সবকিছু ঠিকঠাক মতো তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অন্তর দর্শন বা রুহানী দর্শন দ্বারা দেখলে আমরা সত্যিকার অর্থেই দেখতে পাবো এই মহাবিশ্বের সবকিছু এক বিস্ময়কর, মহা সৃজন ক্ষমতা সম্পন্ন অনন্ত কারখানার মধ্যে স্থাপন করা রয়েছে। এটা একটা মহাসৌন্দর্যময় মহাব্যবস্থাপনা জগত। এই সৌন্দর্য হলো মহান স্রষ্টা থেকে আগত অনন্ত গুনরাজি ও শক্তিময় নূর বা আলো। আরশ থেকে ভূতল পর্যন্ত সবকিছু সৃষ্টির মূল কারণ এই শক্তি ও সৌন্দর্যময় আলো।
জন্মের পূর্বে সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে আত্মা জ্ঞানে যদিও পূর্ণ থাকে তবু তার পিছনের কর্মফল তাকে চম্বুকের মতে টেনে নিয়ে যায় পরবর্তী ফলস্বরুপ দেহ ঘরে। মানব দেহতে এসে সৃষ্টির সর্ব প্রথম নিজের জ্ঞান প্রকাশ করতে গিয়ে আত্মা নিজেই নিজেকে ধোকা দিতে শুরু করে এবং এভাবে চলতে চলতে এক দেহের কর্মফল তাকে আরেক দেহতে গিয়ে ভোগ করতে হয়।
সুতরাং যদি সকল আত্মাই পুরাতন হয় এবং নতুন সৃষ্টি কেউ না হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায় -- আত্মাকে আবার নতুন করে কেন জ্ঞান অর্জন করতে হয়?
যেহেতু জ্ঞান দিয়েই তৈরী হয়েছে আত্মা অর্থাৎ আত্মাই জ্ঞান সেহেতু জ্ঞান অর্জনের বিষয় নয় , জ্ঞান জাগ্রত করার বিষয় , উপলব্ধির বিষয়। জ্ঞান মানুষের অন্তরে ঘুমন্ত, জ্ঞানে মানুষের আত্মা পূর্ণ, প্রয়োজন কেবল আত্মা জাগ্রত করা, আত্মা কে চেতন করা। তাই ফকির লালন শাঁইজী বলেছিলেন-- আত্মা রুপে কর্তা হরি; আবার -- আত্মা চেতন হলে জানতে পাবি।
আত্মার এই জ্ঞান থাকে সুপ্ত বা ঘুমন্ত সেই জ্ঞান জাগাতে হয় । আত্মার জ্ঞান পূর্ণ জাগ্রত হলেই আত্মা পূর্ণ শক্তিশালী হয়ে উঠবে,আত্মা পাবে তার কাঙ্খিত পূর্ণতা । আত্মার জ্ঞান পূর্ণ জাগ্রত করতে পারলেই মিলবে মানুষের পূর্ণ মুক্তি তখন মানুষের বা আত্মার
কোন সীমাবদ্ধতা থাকবেনা । আত্মা হয়ে যাবে পূর্ণ শক্তিশালী পূর্ণ স্বাধীন।
যেমন: সালাত অর্থ স্বরণ করা।
এই স্বরণ শুধু হাতে গুণা পাঁচ ওয়াক্তে টাইম মাফিক নয়, পাঁচ ওয়াক্ত হচ্ছে প্রাথমিক ট্রেনিং। এই ট্রেনিং এ পাশ করার পর প্রতিটা দমে দমে আল্লাহ কে স্বরণ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং যিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এমন একজন মহা মানবের নিকট শপথ গ্রহণ করে স্বরুপ কে প্রতিষ্ঠিত করার উপায় খুজে বের করতে হবে। অত:পর এই স্বরণ এমন হতে হবে যে, স্বরণ করতে করতে মহা সত্ত্বার সাথে সংযোগ হয়ে আপন সত্ত্বা জাগ্রত হয়ে উঠবে। সত্ত্বা অর্থ আত্মা। সুতরাং মহাসত্ত্বা বা মহা আত্মার সাথে সংযোগ করে আপন আত্মাকে জাগ্রত করাই সালাত। আর আপন আত্মা য্খন চেতন হবে শুধু তখনই সালাত কায়েম হবে।
আবার পূজা অর্থ = পূ + জা
= পূণ + জাগরণ
অর্থাৎ আপন আত্মাকে পূণরায় জাগরণ করাই পূজা। এখানে আত্মা দেহমুক্ত অবস্থায় পূর্বে জাগরণ ছিল, দেহের মধ্যে ঐ ঘুমন্ত আত্মাকে আবার পূণরায় জাগরণ করতে বলা হয়েছে। আর ইহাই প্রকৃত ঈশ্বর পূজা।
আর আত্মাকে পূর্ণ জাগ্রত করতে হলে আরেকটা জাগ্রত আত্মার সাথে তথা কামেল মুর্শিদী আত্মার সাথে পরশ বা ঘর্ষণ পাওয়ার জন্য তার সোহবত গ্রহণ করতে হবে।
এজন্য মুর্শিদ ধরিবার আছে প্রয়োজন। মুর্শিদী আত্মারুপ দেখিবার করিতে হয় সাধন। একবার যদি হয় দেখাদেখি করণ। মুর্শিদী আত্মার রুপের আলোতে নিজ আত্মার রুপ হবে দর্শন তথা স্ব-রুপ আত্মা হবে জাগরণ এবং এমনাবস্থায় কেউ নিজেকে রাখে গোপন আবার কেউ ভাব হারিয়ে সদায় করে উচ্চারণ--
"একমাত্র আমি-ই ছিলাম এক, আমি-ই আছি এক, আজ শুধু আমি-ই জাগ্রত এবং আমি-ই কাঙ্খিত মহা দর্শন।
এমনাবস্থায় সাধকের দেহের ওজনের পরিমাণ শূন্য হয়ে যায় এবং ইচ্ছানুযায়ী সে শূন্যে উড়ে বেড়ায়। তখন সে মনের আনন্দে বলতে থাকে
"তুমি" দর্শনে পেয়েছি "আমি" দর্শন
"আমি" দর্শনে পেয়েছি "তুমি" দর্শন
নয়ন ভরে দেখেছি এই বিশ্ব ভুবন""
কে তুমি - কে আমি নাইকো আজ বিভাজন ""
যতদিন গুরু রুপের ধেন
গুরুর আত্মারুপ দর্শন না হবে
ততদিন নিজ আত্মার স্বরুপ দর্শন
অদেখা রবে।
যতদিন মনের মানুষকে না দেখিবে
ততদিন নামে মাত্র মুরিদ হয়েছি
নিজেকে জানিবে।
- সুফীবাদ -
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন