রবিবার, ২০ মার্চ, ২০২২

সেজদায়ে তাজেমী

সেজদায়ে তাজিমি কি ও কেন ?

সেজদায়ে তাজিমির বিরুদ্ধে বানানো হয়েছে একটি মাত্র হাদিস। তাও আবার হাদিসখানা একজনের দ্বারা বর্ণিত। পৌনে দু'শত বছর আগে উনি যাদের কাছে শুনেছেন উনাদের নামধাম বলতে না পারলেও উনি বলেছেন। মানুষ মানুষকে সেজদা দেবে এটা পছন্দ হবার কথা নয়। যত বড় দলিলই দেওয়া হোক না কেন, মানুষ যেহেতু আমিত্বের চার দেয়ালে বাস করে তাই সেজদায়ে তাজিমিকে হারাম বলা হয়েছে। অবশ্য সবাই নয়। কিছু কিছু আলেমেরা এর বিরোধিতা করেছে এবং করছে। কোরানের সূরা ইউসুফের একশত নম্বর আয়াতের পরিষ্কার দলিলটি যদি দেখিয়ে সেজদায়ে তাজিমির কথাটি বলতে চান, তবু মেনে নেবে না। কারণ যারা কিছুতেই মানবে না তাদের মানাবেন কেমন করে? এই সামান্য কথাটির যে কত দলিল কোরানে দেওয়া হয়েছে তাও কি বলতে হবে? যদি নাসেক মনসুখের কথা উঠাতে চান, তাহলে আজ পর্যন্ত এই সূরা ইউসুফের একশত নম্বর আয়াতটি মনসুখ করা যায় নাই। কারণ এই আয়াতটি মনসুখ করতে হলে অন্য আয়াতের প্রয়োজন। কিন্তু কোরানে এ রকম স্পষ্ট আয়াতের বিরুদ্ধে দলিল দেবার মতো একটি আয়াতও নেই । মওলানা জালালুদ্দীন সয়ুতির মতো জাঁদরেল আলেম এবং মোল্লা জীউনের মতো শরিয়তের সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তি এই আয়াতটিকে মনসুখ করে যাননি। মাত্র একজনের বর্ণিত হাদিস, যাকে হাদিসে ওয়াহেদ বলা হয় তথা খুবই দুর্বল হাদিস, সেটিকে সামনে রেখে কোরানের আয়াতটিকে কেটে দেয়। অথচ চার ইমাম বলেছেন কোরানের আয়াতকে কোন হাদিস দিয়েই কাটা যায় না এবং যাবার প্রশ্নই উঠতে পারে না। এতকিছু জানবার পরও তারা সেজদায়ে তাজিমিকে হারাম করেছে। কারণ সেজাদায়ে তাজিমি এদের কাছে পছন্দ হয় না। পছন্দ হয় না ভালো কথা, তাই বলে কি হারাম করে দেবেন? এতবড় সত্যটিকে হারাম যে করা যায় না কোন অবস্থাতেই, তাও বোধ হয় এদের জানা থাকার কথা। যারা প্রকৃত জ্ঞানী, যারা জ্ঞান গবেষণাকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা ও সমীহ করেন তারা জানেন যে, এই সেজদায়ে তাজিমি জায়েজ অর্থাৎ হারাম নয়। কারণ মহানবীকে প্রাণীরা যে সেজদা করেছে তারও বহু দলিল আছে। প্রাণীরা সব সময় তৌহিদে বাস করছে। এটা আমার কথা নয় বরং কোরানের ঘোষণা। সুতরাং প্রাণীকুল তৌহিদে বাস করছে বলা হলে শেরেক করার প্রশ্নই আসতে পারে না। কারণ যারা তৌহিদে সব সময় বাস করছে তারা কেমন করে শেরেক করে? শেরেক করার প্রশ্নই আসতে পারে না। অথচ মহানবীকে সেজদা করেছে। মহানবীকে সেজদা করা যদি শেরেক হতো, তাহলে তিনি মানা করতেন, পবিত্র পা মোবারক অবশ্যই সরিয়ে নিতেন। হযরত ইউসুফ (আঃ) অতি উঁচু মাপের নবী এবং তাঁর বাবা হযরত ইয়াকুব (আঃ) ও বড় নবী। তাদের নাম এবং ঘটনাবলী কোরানে বলা হয়েছে। হযরত ইউসুফ নবীকে উঁচু আসনে বসিয়ে তাঁর বাবা হযরত ইয়াকুব নবী সেজদা করলেন। আরবী শব্দটি হলো লাহু অর্থাৎ তাঁর পা মোবারকে। নবী নবীকে সেজদা করার দলিল কোরানে পেলাম। একটু ভেবে দেখুন তো! বিষয়টি অবাক করার মতো নয় কি? বাবা নবী ছেলে নবীকে সেজদা করছেন। আমরা সমাজে বাস করি। কিন্তু এখানে সমাজও কি কিছুটা অবাক হবে না? কারণ বাবা কেমন করে ছেলেকে সেজদা করেন? এই একবিংশ শতাব্দীতেও যদি এমন দৃশ্য আমরা দেখি, তাহলে অবাক-এর উপর অবাক হবো। আমাদের সমাজ বাবাকে ছালাম করতে বলে কিন্তু একি দৃশ্যের বর্ণনা কোরানে পাই যে, বাবা তাঁর ছেলেকে সেজদা করছেন। তাও আবার সবচাইতে ছোট ছেলেকে সেজদা করছেন। কেবল বাবাই সেজদা করেননি বরং সেই পরম প্রিয় মা-ও তাঁর ছোট ছেলেকে তথা ইউসুফ নবীকে সেজদা করলেন। আমরা জানি, মা এর পায়ের তলে সন্তানের বেহেস্ত। অথচ সেই মা সেজদা করছেন তাও আবার ছোট ছেলেকে। এই বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সেজদা দেবার মাঝে কি কোন বিরাট রহস্য লুকিয়ে আছে, যা আমাদের সাধারণ বিচার বুদ্ধিতে ধরা পড়ছে না? তারপর বড় বড় এগারো ভাইও সেজদা করলেন। কোরান কিন্তু সোজাসুজি বলছে এবং কোন রূপকের আশ্রয় নিয়ে নয়! এই সেজদাকে কোরান কিন্তু সেজদায়ে তাজিমি বলেনি, কেবল সেজদার কথা বলা হয়েছে। আমরা শাস্ত্রবিশারদরা এই সেজদাকে ভাগ করে নিয়েছি। তাই আমরা কোরানের বর্ণিত এই সেজদাকে “সেজদায়ে তাজিমি” ল। অনেক বড় বড় অলীরা তো এই সেজদাকে ভাগ করে বলেননি! আমি শাস্ত্রবিশারদদের পথ অনুসরণ করে বলছি যে এই সেজদা “সেজদায়ে তাজিমি” তথা সম্মানের সেজদা। কোরানের এই আয়াতটি হুবহু তুলে ধরছি এজন্য যে, দেখুন তো সেজদায়ে তাজিমির কথাটি বলছে কি-না! “ওয়া রাফা আবাওয়াইহি ওয়া খাররু লাহু সুজ্জাদা।” এর পরেও কি আমরা অস্বীকার করতে চাইবো? ভালো না লাগে সেজদা দেবেন না। তাই বলে কি ধানাই পানাই করে এবং অনেক কথার মারপ্যাচ দিয়ে নাজায়েজ করতে চাইবেন? এই বিবেকটাকে একটু নিরপেক্ষ করে দেখুন তো! আপনার বিবেক কি বলে? ভালো লাগে না অথবা মন চায় না তাই সেজদা করবো না বলা এক কথা। আর এরকম সেজদা করাটা নাজায়েজ বলা সম্পূর্ণ অন্য কথা। এর পরেও কি আপনি একটি মাত্র হাদিস তাও আবার সনদ ছাড়া, একজনের বর্ণিত, তাও আবার প্রায় দু'শত বছর পরে, এ রকম একদম দুর্বল হাদিস দিয়ে কোরানের আয়াতটিকে বাদ করে দিতে চাইছেন? যেখানে চার মাযহাবের চার ইমাম এবং যারা মাযহাব মানেন না তারাও এক বাক্যে বলছেন যে, হাদিস দিয়ে তা সেই হাদিস যত সহীহ হোক না কেন, সেই হাদিস দিয়ে কোরানের আয়াতকে বাদ বা অচল করাতো যাবেই না, বরং বাদ করার প্রশ্নই উঠতে পারে না। যারা হাদিস দিয়ে, কোরানের আয়াত বাদ করতে চাইবে তারা বিরাট ভুল এবং অন্যায় করবে। তারপরেও আমরা সেজদায়ে তাজিমির বিষয়টি নিয়ে মাঠে ময়দানে বাহাস করি। মুসলমান ভাইকে অনেক রকম ফতোয়া দিয়ে গালমন্দ করি। এই সামান্য বিষয়টি নিয়ে যদি মুসলমানে মুসলমানে মারামারি দলাদলি করি তাহলে নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে সবাই এক হতে পারবো কি? মহা ঐক্যের বদলে এই বড় ফাটলগুলো মুসলমানদেরকে কোথায় নামিয়ে এনেছে। এই বিষয়টি নিয়ে বড় বড় আলেমদের মতামত দলিলসহ তুলে ধরলেই কি সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে? কারণ যারা নাজায়েজ বলছেন আমি তাদের একটি মাত্র কথা বলেই শেষ করতে চাই যে, .............. (চলবে)

পর্ব _১

গ্রন্থ: সূফীবাদ আত্মপরিচয়ের একমাত্র পথ (পৃষ্ঠা: ১০৭-১০৮)

- চেরাগে জান শরিফ বিনয়ের সম্রাট ডা. কালান্দার বাবা জাহাঙ্গীর বা-ইমান আল সুরেশ্বরী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন