পরকাল কি?
হাশরের মাঠ কি?
পুনরুত্থান কি?
মা আয়শা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা:) বলেন, " হাশরের মাঠে প্রত্যেকেই উলঙ্গ হয়ে, নাঙা পায়ে (খালি পায়ে), খাতনাবিহিন অবস্থায় উঠবে।" সম্ভবত এই হাদীসের মর্ম বুঝতে না পেরে হুজুরগণ হাশরের মাঠের অশ্লীল ও কাল্পনিক বর্ণনা তৈরি করেছেন (হাশরের মাঠে নবী রাসুলসহ সকলেই (পিতা মাতার সামনে পুত্র কন্যা, পুত্র কন্যার সামনে পিতা মাতা) নেংটা হয়ে সমবেত হবে)। এমন অশ্লীলতাকে ঢাকার জন্য এরা গোঁজামিল দিয়ে বলে, সকলে আপন আপন হিসাব নিয়ে এত পেরেশান থাকবে যে, কেউ কারো দিকে তাকাবে না। সকলে উপরের দিকে তাকিয়ে ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করবে। আসল কথা হলো, যদি হাশরের মাঠে মানুষজন আল্লাহর ভয়ে এতই ভিত থাকবে যে, তারা আপন পিতা মাতাকে চিনবে না বা পুত্র কন্যাদের চিনবে না, তাহলে তো সকলে ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি না করে আল্লাহু আল্লাহু ডাকার কথা। অথচ ধর্ম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকা হুজুরদের কারণে হাশরের বর্ণনা এমন অশ্লীল ও গোঁজামিল দিয়ে প্রচারিত হয়ে সমাজে খুব শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সমাজে হুজুররা বলেন, হাশরের মাঠে একে অপরকে চিনবে না বলেই একে অপরের সামনে উলঙ্গতায় লজ্জিত হবে না। কুরআনে আল্লাহ কিন্তু ভিন্ন কথা বলেছেন। আল্লাহ বলেন, হাশরের মাঠে একে অপরকে চিনবে (সূরা ইউনুস, আয়াত-৪৫)। অথচ হুজুররা বলেন কুরআন বিরোধী কথা।
হাশর বিষয়ে আলোচনার পূর্বে বেহেশত ও দোযখ নিয়ে একটু আলোচনা করলে বুঝতে সুবিধা হবে-
সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এক একজন বেহেশতবাসীকে এত বড় বড় বেহেশত প্রদান করা হবে যে, বেহেশতের এক প্রান্ত হতে খুব দ্রুতগতিতে দৌড়ালেও অপর প্রান্তে পৌছাতে কয়েক মাস লেগে যাবে। আবার দোযখের আগুন সম্পর্কে বলা হয় যে, পৃথিবীর আগুনের তাপের সত্তরগুন বেশি তাপ হবে দোযখের আগুনের। পৃথিবীর আগুনে কেউ যদি হাত রেখে কারো সাথে কথা বলতে চায়, সে কি পারবে? আগুনের তাপে যখন তার হাত পুড়বে সে তো চিৎকার করে হাত বাঁচাতে ব্যস্ত থাকবে। কারো সাথে আলোচনা করার প্রশ্নই আসে না। কিন্ত কুরআনে একাধিক আয়াতে আল্লাহ বলেন, বেহেশত ও দোযখীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। যেমন, দোযখীরা বেহেশতীদের বলবে, আমাদের দিকে কিছু পানি নিক্ষেপ করো, তোমাদের রুজি হতে আমাদের কিছু দাও। বেহেশতীরা বলবে, কাফেরদের জন্য এগুলো হারাম করা হয়েছে (সূরা আরাফ, আয়াত-৫০)। এখানে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, বেহেশতী ও দোযখীরা পাশাপাশি অবস্থান করবে আর তা না হলে, তাদের মধ্যে আলোচনা সম্ভব নয়। আর পৃথিবীর আগুনের চেয়ে সত্তরগুন বেশি তাপযুক্ত আগুনে পুড়তে থাকা কোন মানুষের পক্ষে কোনকিছু আবদার করা তো অসম্ভব। আসলে বেহেশতের সুখ ও দোযখের আগুনের রূপক বর্ণনা বুঝতে না পেরে বেহেশত ও দোযখের এমন কাহিনী প্রচার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরো বলা যায়, দোযখীদের কঠোর আযাব সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, " সর্বক্ষণ তারা তাতে থাকবে। তাদের আযাব হালকাও হবে না। কিন্তু যারা অত:পর তওবা করে নেবে এবং সৎকাজ করবে তারা ব্যতীত, নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু (সূরা ইমরান, আয়াত-৮৯, ৯০)। এই আয়াত দুটির প্রথম আয়াতে দোযখীরা তাদের কর্মের শাস্তিসরূপ দোযখে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে থাকবে যা হালকা করা হবে না। কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেন, যারা তওবা করবে এবং সৎকাজ করবে তাদেরকে ক্ষমা করা হবে। অর্থাৎ তারা এমন জায়গায় শাস্তি ভোগ করবে সেখানে তারা তওবা করতে পারবে সৎকাজও করতে পারবে। আর সেই জায়গাটা দুনিয়া ছাড়া আর কোথায় হবে?
সুফি সাধকগণ, হাশর বিষয়ে মা আয়শা বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যা দেন এভাবে-
হাশরে পুনরায় সকলকে উলঙ্গ করে নাঙা পায়ে খাতনাবিহিন অবস্থায় উঠানো হবে বলতে মৃত্যুর পরে পুনরায় মায়ের গর্ভ হতে দুনিয়াতে আসাকে বুঝানো হয়েছে। প্রত্যেক নবী রাসুল এবং সকল মানুষ মায়ের গর্ভ হতে উলঙ্গ হয়ে, খালিপায়ে, খাতনা ছাড়াই জন্ম নেয়। আর শিশুদের উলঙ্গতা কারো জন্য লজ্জার কারণ হয় না।
কুরআন একটি আধ্যাত্মিক কিতাব। কুরআনে আছে রূপক আয়াত, উপমার আয়াত, ইঙ্গিতময় আয়াত ও উদাহরণ দেওয়া আয়াত। আমাদের ধর্ম প্রচারকদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান না থাকায় কুরআনে বলা আল্লাহর কথার মর্ম বুঝতে না পেরে এমন গোঁজামিল ব্যাখ্যাকে কুরআনের কথা বলে প্রচার করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-
"কেমন করে তোমরা কুফরী করছ? অথচ তোমরা ছিলে মৃত। অত:পর তিনিই তোমাদের প্রাণ দান করেছেন, আবার মৃত্যু দান করবেন। পুনরায় তোমাদেরকে জীবনদান করবেন। অত:পর তারই দিকে প্রত্যাবর্তন করবে (বাকারাহ, আয়াত-২৮)।" এটা তো একটা বাচ্চাও বুঝবে যে, যে আত্মাটা একবারও দুনিয়াতে আসেনি, সেই আত্মার মৃত্যু হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আবার মৃত্যু না হলে পুনরায় জীবনদানের কথা আসবে না। এই আয়াতে আল্লাহ পরিষ্কার বলেছেন, আবার মৃত্যু দিব অর্থাৎ সেই আত্মাগুলির আগেও মৃত্যু হয়েছে। পুনরায় জীবন দান করবেন অর্থাৎ এদের ইতিপূর্বে জীবনদান দেওয়া হয়েছিল। আসল কথা, মানুষ জন্ম নিচ্ছে আবার মৃত্যু বরণ করছে আবার জন্ম নিচ্ছে। আল্লাহ কয়েকধাপে কথাগুলো বললেও জন্মচক্র এই কয়েকধাপে সীমাবদ্ধ নয়। বরং অনন্ত কাল ধরে মানুষ কর্মফল ভোগ করতে দুনিয়াতে আসতে থাকবে যতক্ষণ না নিজে কর্ম করে আল্লাহতে বিলীন হতে না পারে। আর এটাকেই বলে মুক্তি অর্থাৎ জন্মচক্র হতে মুক্তি লাভ করা।
"প্রত্যেকের জন্য তাদের কর্মফল অনুযায়ী বিভিন্ন স্তর রয়েছে, যাতে আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেন (সূরা আহক্বাফ, আয়াত-১৯)।"
"অত:পর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেওয়া হবে, অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব-নিকাশ করা হবে আর সে তার পরিবার পরিজনের কাছে আনন্দিত হয়ে ফিরে যাবে (সূরা ইনশিকাক, আয়াত-৭, ৮, ৯)।" এটা তো আর বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না যে, দুনিয়াতে থাকা পরিবার পরিজনের কাছেই সে আনন্দিত হয়ে ফিরবে।
"অবশ্যই তোমরা এক স্তর হতে অন্য স্তরে আরোহণ করবে (সূরা ইনশিকাক, আয়াত-১৮)।" দুনিয়ায় কর্ম অনুযায়ী আত্মার প্রমোশন ও ডিমোশনের কথা বলা হয়েছে।
কর্মফল ভোগ করতে মানুষকে আবার দুনিয়াতে আসতে হবে। আর কুরআনেই একথা বলা হয়েছে। যদি পুনর্জন্মের বিধান না থাকত, তাহলে সকল নবী রাসুলগণ আল্লাহর সৃষ্টির বিধান সম্পর্কে জানার পরেও এমন বিধান বিরোধী হয়ে আখেরি নবীর উম্মত হওয়ার জন্য দোয়া করতেন না। আর রাসুল (সা:) নিজেই বলেছেন, " আমি প্রত্যেক যুগে আদম সন্তানদের মাঝে সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করিয়া আসিতেছি, অবশেষে আমি ঐ যুগে জন্মগ্রহণ করেছি, বর্তমানে আমি যে জামানায় আছি (বোখারী শরীফ)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন