শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৮

যোগ ( জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার সংযোগ)১/ পর্ব

যোগ কি: সংস্কৃত যোগ শব্দটি ইংরেজীতে  YOGA । YOGA -যোগ মানে ব্যায়াম নয়। শরীর, মন, ও আত্মার ক্রম উন্নয়নের যে পদ্ধতি (Method) সমাধী  স্তরে পৌঁছায় তাই যোগ- YOGA। শরীর, মন, বুদ্ধি ও অহংকার আত্মারই বিভূতি বা শক্তি। যোগ বুঝতে হলে নিজের সংকীর্ন গন্ডি ছেড়ে সৃষ্টির মূলের দিকে তাকাতে হবে। যোগ মানে আদির সংগে প্রান্তের যোগ, বৃহতের সংগে ক্ষুদ্রের যোগ, জীবাত্মার সংগে পরমাত্মার যোগ, সৃষ্টির সংগে  স্রষ্টার যোগ। ‘যোগসূত্র’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় সূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি যোগের বর্ননা দিয়েছেন-‘চিত্তবৃত্তি নিরোধ’। চিত্ত এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত। মন, বুদ্ধি ও অহংকার এই তিনের সামূহিক অর্থে এবং এই তিনটিকে বিক্ষিপ্ত হওয়া থেকে অর্থাৎ বিপথগামী হওয়া থেকে নিবৃত্ত করাই যোগ।

সৃষ্টির মূলতত্ত্ব ক্রম বিকাশ। ভাব থেবে বস্তু, অরূপ থেকে রূপ, এক থেকে বহুকে এনে যখন  স্রষ্টা জগৎ সৃষ্টি শুরু করে ছিলেন তখন থেকেই এই ক্রম বিকাশের গোপন ক্রিয়া শুরু। মতভিন্নতায় ১৩৭০ কোটি বছর আগে সৌরজগত তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৫০০ কোটি বছর আগে সৌরজগত তৈরি হয়। ৪৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবী তৈরি হয়। যোগের প্রশ্ন এসেছে অনেক পরে, ক্রমে ক্রমে। প্রথমে ছিল শুধু জড়বস্ত, তারপরে এল প্রান, তাও ৫৭ কোটি বছর আগে। প্রানের পূর্নতা প্রাপ্তির পরে এল মন। মন হল অপূর্ব চেতনাময় এক অদৃশ্য যন্ত্র। মনের বিশেষ কাজ ভাবের সঙ্গে বস্তুর মিলনের সেতু স্বরুপ হওয়া।

শুধু পার্থিব বস্তু নিয়ে মন চলতে পারে না। পার্থিব বস্তুকে নিয়ে মন ছুটতে চায় ভাবের আর্দশের দিকে। শিল্পী, কবি, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা স্থুল বাস্তবের মধ্যে থেকে ও কিছু সূক্ষ্ম আদর্শ খুঁজে বেড়ান। মনের সার্থকতা হচ্ছে অস্তিত্বের মূল সমস্যা আঁকড়ে ধরে উৎপত্তির গোড়ায় উপস্থিত হয়ে মীমাংসায় পৌঁছানো।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যে সব কিছুর মূলে, সব কিছুর উৎপওি যে  তাঁর থেকেই, অনেক সময় আমরা তা বুঝতে পারি না। আমরা দেখি প্রত্যেকেই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ন এক স্বতন্ত্র সত্ত্বা। সংসারের সংগে আমাদের যোগ রয়েছে বটে, বস্তু ও বিশ্বের সঙ্গেও যোগ রয়েছে, কিন্তু যাকে বলা হয় মূল সত্ত্বা তার সংগেই কোনো যোগ নেই। শুধু বস্তুযোগ নিয়ে জীবন কাটালে জীবন হয় গতানুগতিক, অর্থহীন। মন চায়, গতানুগতিকতার উর্ধ্বে বৃহত্তর চেতনা লাভ করতে। সংসার, অর্থ ও বস্তু সম্পদের সঙ্গে যোগ প্রকৃত যোগ নয়। প্রকৃত যোগ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মিলন। এই মিলন ঘটানোর প্রচেষ্টার নাম হচ্ছে, যোগ সাধনা। এক কথায় পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সংযোগের উপায় বিধানের নামই যোগ।

সৃষ্টিকর্তা এক ও অভিন্ন, তিনিই সব, তিনি ছাড়া আর কিছুই নেই। তিনি সকল সংজ্ঞার অতীত। তিনি এক হয়েও বহু, অরূপ হয়েও রূপময়, অব্যক্ত হয়েও চরাচরে ব্যক্ত। তিনি বিশ্বাতীত তিনি প্রতিপালক, তিনি আরো অনেক কিছু। তাঁর অস্তিত্ব, চেতনা ও আনন্দ অনন্ত, এমন যে সৃষ্টিকর্তা শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে চাই যোগ। আমার মন, প্রান, দেহ, বুদ্ধি, ইচ্ছা সমস্তই চাইবে সেই যোগ।

যোগের পথে প্রয়াস , কেমন করে ধ্যেয় বস্তুকে চিত্তের আশ্রয়ে অধিষ্ঠিত করা যায়, কেমন করে সেই পরম তন্ময়তা লাভ করা যায়, যাতে মনের দর্পনে সুস্পষ্টভাবে জেগে থাকবে শুধু ধ্যেয় বিষয়ের ছবি। যোগ দৃষ্টি দিয়েছে আশ্রয়ের দিকে, আঁধারের দিকে এবং তাকে নিখুঁত ও নির্দোষ করে তোলার জন্যেই সমস্ত প্রয়াস কেন্দ্রীভূত করেছে। চিত্ত চিরচঞ্চল তাই তাতে কোনো কিছুর সুস্পষ্ট ছায়া ধরা পড়ে না। এই চলমান, অস্থির আশ্রয় স্বরুপ চিত্তকে কেমন করে শান্ত, সুস্থির করে তোলা যায় এটিই হল সাধারণ পদ্ধতি। সংস্কৃত ভাষায় বলা যায় ‘ক্লেশ তিমির বিনাশো যোগ প্রদীপ’ যার অনির্বান অকম্প প্রভায় সব উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, অজ্ঞানের ক্লেশ ও অপরিচয়ের অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। যোগ বলে কাম, ক্রোধ, মোহ, অনুরাগ, স্নেহ এই পাঁচটি চিত্তবৃত্তি পরিহার করতে পারলে মানুষের মুক্তি লাভ হয়। যিনি অহিংসাব্রত পরায়ন হয়ে নাভি, মস্তক, কন্ঠ, হৃদয়, বক্ষ, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা প্রভৃতি স্থানে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যোগ করাতে পারেন তিনিই মুক্তি লাভ করতে পারেন।

যোগের প্রকারভেদ:

যোগ ৪টি মার্গে বিভক্ত। মন্ত্র যোগ, লয়যোগ, বাজযোগ ও হঠযোগ। যোগ মার্গের চারটি পথ হলে ও সাধারন লক্ষ্য এক, স্রষ্টার সন্তুষ্টি, সমাধি এবং অনন্ত মুক্তি।

১.            মন্ত্রযোগ:  স্রষ্টার নাম জপ করতে করতে যে মনের লয় হয় তা-ই  মন্ত্রযোগ।

২.            লয়যোগ: শরীরের নবচক্রে অর্থাৎ নাড়ি গ্রন্থিস্থানে চিত্তলয় করে যে যোগ সম্পদ ও মোক্ষ লাভ হয় তা-ই লয় যোগ।

৩.           রাজযোগ: মন ও শরীর নিশ্চল, স্থির সমাধিপ্রাপ্ত হওয়াই রাজযোগ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন